দেবিকা মজুমদার
আরজিকর ধর্ষণ কাণ্ডে সুপ্রিম কোর্ট সুয়োমোটো বা স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে মামলা গ্রহণ করেছিল। এর দশ মাস পরে কসবার ঘটনা নিয়ে আদালত যাতে স্বতঃপ্রণোদিত মামলা গ্রহণ করে তার জন্য আবেদন জানানো হয়েছে উচ্চ আদালতে এবং শীর্ষ আদালতে। জানেন কি এই স্বতঃপ্রণোদিত মামলা কী? কখন এ ধরনের মামলা গ্রহণ করা হয় বা এত দিন পর্যন্ত ভারতে এ ধরনের ক’টি মামলা গৃহীত হয়েছে? শুধু তাই নয় স্বতঃপ্রণোদিত মামলা কতটা কার্যকর বিচারব্যবস্থায়?
স্বতঃপ্রণোদিত মামলা—কী এই ‘সুয়োমোটো’?
‘স্বতঃপ্রণোদিত মামলা’ বা ইংরেজিতে সুয়োমোটো কেস এক বিশেষ ধরনের আইনি প্রক্রিয়া। যেখানে আদালত নিজেই কোনও ঘটনা বা বিষয়ের প্রেক্ষিতে বিচার শুরু করে। সাধারণত, কোনও ব্যক্তি বা পক্ষ আদালতে আবেদন করলে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। কিন্তু স্বতঃপ্রণোদিত মামলায় আদালত নিজে থেকেই হস্তক্ষেপ করে, কোনও আবেদন ছাড়াই। এই উদ্যোগ আসে অনেক সময় সংবাদপত্র, চিঠি, মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা, প্রশাসনিক ব্যর্থতা বা জনস্বার্থ রক্ষার প্রয়োজনীয়তা দেখে।
আদালত কখন নেয় এ ধরণের মামলা?
সুপ্রিম কোর্ট এবং উচ্চ আদালতগুলি সাধারণত নিম্নলিখিত পরিস্থিতিতে স্বতঃপ্রণোদিত মামলা গ্রহণ করে:
১) জনস্বার্থে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা (পাবলিক ইন্টারেস্ট লিটিগেশন বা পিআইএল)
যেমন – বায়ু দূষণ, গঙ্গা দূষণ, অবৈধ নির্মাণ, শিশু শ্রম, নারীর সুরক্ষা।
২) সংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘন
যেমন – বিনা বিচারে কারাবাস, পুলিশি হেফাজতে মৃত্যু, রাজনৈতিক হিংসা, ধর্ষণ বা গণধর্ষণ।
৩) বিচার ব্যবস্থার মর্যাদা রক্ষা
আদালত অবমাননা, আইনজীবীর ওপর আক্রমণ, সাক্ষীদের নিরাপত্তা ইত্যাদি ঘটনায়।
৪) প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা জরুরি অবস্থায় প্রশাসনের ব্যর্থতা
যেমন – করোনা অতিমারিতে অক্সিজেন সংকট, হাসপাতালের পরিষেবার অভাব ইত্যাদি।
এই পর্যন্ত বললে শুধু মাত্র স্বতঃপ্রণোদিত মামলার সংজ্ঞা বোঝানো যায়। জানেন কি, ১৯৯০ সাল থেকে এখনও পর্যন্ত কত গুলি স্বতঃপ্রণোদিত মামলা হয়েছে? প্রথমেই চলে আসি সুপ্রিম কোর্টের হিসেবে।
সুপ্রিম কোর্ট:
১৯৯০ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত মোট ৬৬টি স্বতঃপ্রণোদিত মামলা গ্রহণ করেছে ভারতের শীর্ষ আদালত।
এর মধ্যে ২০২০-২০২৪ সময়ে ৩৫টির বেশি মামলা হয়েছে, যা এক দশকের মধ্যে সর্বাধিক।
২০২৪ সালে একমাত্র বছরে ১২টি স্বতঃপ্রণোদিত মামলা নেওয়া হয় – সুপ্রিম কোর্ট ইতিহাসে সর্বোচ্চ বার্ষিক সংখ্যা।
এ বার উচ্চ আদালতে এধরনের কতগুলি মামলা হয়েছে সেই হিসাব।
উচ্চ আদালত:
দেশের ২৫টির বেশি হাই কোর্টেও বিভিন্ন সময়ে স্বতঃপ্রণোদিত মামলা নেওয়া হয়েছে।
এলাহাবাদ, বম্বে, দিল্লি, কলকাতা, চেন্নাই হাই কোর্টের মত প্রায় সব বড় আদালতেই ২০২০–২০২৪ সালের মধ্যে একাধিক বার এমন মামলা গৃহীত হয়েছে। নির্দিষ্ট সংখ্যা পাওয়া না গেলেও অনুমান করা হয় এই সময়সীমার মধ্যে ১০০টির বেশি স্বতঃপ্রণোদিত মামলা হাই কোর্ট স্তরে হয়েছে।
কিছু নজরকাড়া স্বতঃপ্রণোদিত মামলার তালিকা:
১) সুপ্রিম কোর্ট (২০২১): করোনা সংকটে অক্সিজেন ও চিকিৎসা নিয়ে রাজ্য সরকারগুলির ভূমিকা নিয়ে নিজে থেকেই মামলা নেয়।
২) এলাহাবাদ হাই কোর্ট (২০২০): হাথরস গণধর্ষণ কাণ্ডে স্বতঃপ্রণোদিত মামলা।
৩) কলকাতা হাই কোর্ট (২০২৩): মণিপুর হিংসা নিয়ে নারী নির্যাতন মামলায় স্বতঃপ্রণোদিত হস্তক্ষেপ।
৪) মাদ্রাজ হাই কোর্ট (২০২২): জেল হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনায় স্বতঃপ্রণোদিত মামলা।
এ বার প্রশ্ন উঠতে পারে এই ব্যবস্থা কতটা কার্যকর তা নিয়ে। সব জিনিসেরই যেমন কিছু ভাল দিক থাকে, তেমনই কিছু খারাপ দিকও থাকে। এ ক্ষেত্রে ভাল দিকগুলো হল জনগণের অধিকার রক্ষা দ্রুত হয়, প্রশাসনের জবাবদিহি নিশ্চিত হয়, সমাজে ন্যায়বিচারের বার্তা পৌঁছায়। আর এর খারাপ দিকগুলো বা এ ধরনের মামলার ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় সেগুলি হল এর দীর্ঘসূত্রিতা। মামলা দীর্ঘায়িত হয়, সব সময় অনুসন্ধানেও পূর্ণতা আসে না, সরকারের সঙ্গে সংঘাত সৃষ্টি হয় বহু ক্ষেত্রেই।
শেষে বলা যায়, স্বতঃপ্রণোদিত মামলা হল বিচারব্যবস্থার এক গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। যখন ন্যায়বিচার বিলম্বিত হয়, বা দুর্বল ও নিপীড়িত মুখ বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়, সেই সময় আদালতের এই স্বতঃস্ফূর্ত হস্তক্ষেপই হয়ে ওঠে আশার আলো।

