শুভম দে
‘আনন্দ’ সিনেমার সেই বিখ্যাত সংলাপটার কথা আমরা সবাই জানি। যেখানে রাজেশ খান্না বলেছিলেন, ‘বাবুমশাই, জিন্দেগি লম্বি নেহি বড়ি হোনি চাহিয়ে।’ জীবনটা তো একটা যুদ্ধ। এ যুদ্ধ নিরন্তর। আর এই প্রতিনিয়ত সংঘর্ষ এক করে দেয় জীবনের সাথে খেলার ময়দানকে (Lord’s Test)। জন্ম-মৃত্যু, হার-জিত সবটাই যেন একসূত্রে গাঁথা। মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। এ জীবন অনিশ্চিয়তার। খেলার মাঠও অনিশ্চিয়তার। যেখানে কিছুই থাকেনা, থেকে যায় শুধু লড়াইখানি। যে লড়াই মানুষকে জীবনের থেকেও বড়ো করে তোলে। বড়ো, অনেক বড়ো। জীবন-মৃত্যু, হার-জিত যার কাছে অতি নগণ্য।
‘ফাইন্ডিং নিমো’ (Finding Nemo – Animated film) সিনেমার একটা সংলাপ আমার খুব পছন্দের। যেখানে ডোরি নিমোকে বলছে, “When life gets you down, do you wanna know what you’ve gotta do? Just keep swimming!” আহা! কত বড়ো জীবন দর্শন। সত্যিই তো তাই। জীবনের লাগাম তোমার হাতে নেই। তুমি চালনা করতে পারবেনা এই যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি। কিন্তু তোমার হাতে আছে শুধুমাত্র লড়ে যাওয়া। প্রতিনিয়ত লড়ে যাওয়া। ক্লান্ত হয়ে পড়বে, হাল ছেড়ে দিতে ইচ্ছে করবে। কিন্তু থেমে গেলে চলবেনা। থামলেই জীবন জিতে যাবে তোমার বিরুদ্ধে। তাই শুধুমাত্র লড়ে যেতে হবে। লড়াই, লড়াই, লড়াই। ক্ষিদ্দা বলেছিলেন না, “ফাইট কোনি ফাইট।” এই তো জীবন। এই লড়াইটায় বেঁচে থাকা।
জাজবাত বাংলায় আরও পড়ুন
খেলার মাঠেও (Lord’s Test) ঘটে যায় এরকম কতশত লড়াই। যা একসূত্রে মিলিয়ে দেয় জীবন যুদ্ধের সঙ্গে ক্রীড়াযুদ্ধ -কে। সোমবার লর্ডসও স্বাক্ষী থাকলো তেমন এক লড়াইয়ের। যে লড়াই টিকে থাকার। অস্তিত্বের। যে লড়াই লড়লেন রবীন্দ্র জাদেজা। যে লড়াই লড়লেন জসপ্রীত বুমরাহ, মহম্মদ সিরাজ। পঞ্চম দিন ভারতের জয়ের জন্য প্রয়োজন ছিল ১৩৫ রান। হাতে ছিল ছয় উইকেট। কিন্তু রাহুল ছাড়া দাঁড়াতে পারলেন না পন্থ, ওয়াশিংটন সুন্দরদের কেউই।

হোম অফ ক্রিকেটে (Lord’s Test) যখন আস্তে আস্তে আস্তে যাচ্ছে সিরিজে ২-১ এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্নটা ঠিক তখনই ক্রিকেটের মক্কা অবাক হয়ে দেখলো তিন ভারতীয়র এক অদম্য লড়াই। অসীম শ্রদ্ধায় দাঁড়িয়ে উঠলো লর্ডস। বিপক্ষ ইংল্যান্ডও যেন অভিভূত! ওভারের ছটা বল কোনটা সিঙ্গল নেবেন আর কোনটা ছাড়বেন — এক অসম্ভব টানাপোড়েন, স্যার জাদেজার এক হার না মানা লড়াই দেখলো ক্রিকেট বিশ্ব।
পারছেন না, তবু যেন ছাড়বেন না তিন যোদ্ধা। ক্যামেরা বারবার তাক করছে ঐতিহ্যবাহী লর্ডস (Lord’s Test) ব্যালকনির দিকে। ভারতীয় ড্রেসিংরুম একরাশ গর্ব ও সম্ভ্রম নিয়ে দেখছে তাদের সতীর্থের এই হার না মানা লড়াই। বিশ্ব ক্রিকেট স্বাক্ষী হয়ে থাকলো এক অবিস্মরণীয় লড়াইয়ের। করতালি তে মুখরিত হয়ে উঠলো হোম অফ ক্রিকেট।
আরও পড়ুন
নাহ্! শেষমেশ ম্যাচটা জেতাতে পারেনি তিন ভারতীয় যোদ্ধা। কিন্তু ৬১(১৮১)*, ৫(৫৪) আর ৪(৩০) -এর তিনটি ইনিংস ঢুকে পড়েছে ক্রিকেটের লোকগাথায়। শুধু ক্রিকেটের কেন? বলা ভালো জীবনযুদ্ধের লোকগাথায়। জীবনের জয়গাথায়। শোয়েব বশিরের বলটা যখন অতর্কিতে আচমকা ফেলে দিলো উইকেটের একটা বেল মাথা নীচু করে ভেঙে পড়লেন সিরাজ। বাঁধ মানলো না চোখের জল। উল্টোদিক থেকে জীবনের এই পরিহাস দাঁড়িয়ে দেখছেন জাদেজা। নীরবে। নিঃশব্দে!

আগেই বলেছি জীবন-মৃত্যু, হার-জিত সবটাই জীবনের অঙ্গ। মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ। জাদেজা-বুমরাহ-সিরাজের এই দুঃসাহসিক লড়াই দলকে জেতাতে হয়তো পারেনি কিন্তু পরাজয়ও কি কোনোভাবে স্পর্শ করতে পারলো এই মহাকাব্যিক লড়াইকে? এ লড়াই বেঁচে থাকার। টিকে থাকার। ভেসে থাকার। অস্তিত্ব রক্ষার। এ লড়াই মানুষকে Larger than life -করে তোলে। এ লড়াই মিলিয়ে দেয় ইতিহাসের পুরু, মহাভারতের অভিমুন্য, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের শংকর থেকে জীবন বিপন্ন করে মানবতার স্বার্থে লড়ে যাওয়া নীরজা ভানোট, বিক্রম বাত্রা, সন্দীপ উন্নিকৃষ্ণনদের সঙ্গে ক্রিকেটের ম্যালকম মার্শাল, অনিল কুম্বলে, গ্রেইম স্মিথ, যুবরাজ সিং, নাথান লিঁয়দের। এ লড়াইকে কুর্ণিশ জানায় ইতিহাস। এ লড়াইকে করতালির মাধ্যমে অভিবাদন জানায় বিপক্ষ দেশ। এ লড়াইকে কেড়ে নিতে পারে না সময়ের করালগ্রাস। এ লড়াইয়ে হেরে যেতে যেতেও কানের কাছে ভেসে ওঠে শন মেন্ডেসের সেই বিখ্যাত গান,
“Help me, it’s like the walls are caving in
Sometimes I feel like giving up
But I just can’t
It isn’t in my blood!”

