বাংলা কেন জাতীয় দলকে আর ফুটবলার দিতে পারছে না?
বিশ্বদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
ভারতীয় ফুটবলে এখন চলছে বদলের পালা। দীর্ঘ সময় পর বিদেশির পরিবর্তে স্বদেশি কোচে আস্থা রেখেছে ফেডারেশন। জাতীয় দলের কোচ নির্বাচিত হয়েছেন খালিদ জামিল। তাঁর তত্ত্বাবধানে ভারতীয় দল ঘুরে দাঁড়াতে পারবে কি না, তা তো সময়ই বলবে। তবে ভারতীয় ফুটবলের এই পালাবদলের মাঝে বঙ্গ ফুটবল কাঠামো যে তিমিরে সেই তিমিরেই।
এক সময় বাংলাকে বলা হতো ভারতীয় দলের সাপ্লাই লাইন। এখান থেকেই উঠে এসেছিলেন গোষ্ঠ পাল, পি কে বন্দ্যোপাধ্যায়, চুনী গোস্বামী, শৈলেন মান্নার মতো কিংবদন্তিরা। এ ছাড়াও বাংলা থেকে বিভিন্ন সময় জাতীয় দলে খেলেছেন সুভাষ ভৌমিক, সুরজিৎ সেনগুপ্ত, বিদেশ বসু, প্রশান্ত ব্যানার্জি, কৃশানু দে, মেহতাব হুসেন, রহিম নবীরা। অথচ আজ সেই জাতীয় দলে বাঙালি নাম খুঁজে পেতে দস্তুরমতো হিমশিম খেতে হয়। হঠাৎ কেন এই দুর্দশা কলকাতা তথা বাংলার ফুটবলের? ‘ভারতীয় ফুটবলের মক্কা’ নামে একদা পরিচিত কলকাতা আজ কেন আর সেভাবে খেলোয়াড় জোগান দিতে পারছে না দেশকে?
জজবাত ২৪ বাংলার তরফে ফোনে ধরা হয়েছিল দেশের প্রাক্তন ফুটবলার তথা রাজ্য বিধানসভার সদস্য বিদেশ বসুকে। তিনি কলকাতা ফুটবলের জৌলুস হারানোর জন্য দায়ী করেছেন বর্তমান প্রজন্মের ফুটবলের অনীহাকে। ভারতের হয়ে ৮ টি ম্যাচে অংশ নেওয়া এই প্রাক্তনী জানান, “প্লেয়ার উঠছে না, এটাই আসল কারণ। শুধু বাবা-মা চাইলেই তো হবে না। টেকনিকও ঠিকঠাক থাকা চাই। সত্যি কথা হল, বর্তমান প্রজন্ম ফুটবলের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। তারা ফুটবলের প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে।”
যদিও ভারতের হয়ে খেলা আরেক বাঙালি ফুটবলার রহিম নবীর মত একেবারেই ভিন্ন। দেশের জার্সিতে দু’বার (২০০৫, ২০১১) সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জেতা এই ফুটবলারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি সরাসরি আঙুল তুলেছেন পূর্বতন কোচদের পক্ষপাতদুষ্ট আচরণের দিকে। নবী বলেন, “মানালো মার্কেজ একইসঙ্গে গোয়া এবং ভারতীয় দলের কোচ ছিলেন। ফলে তিনি গোয়ার বেশিরভাগ খেলোয়াড়কে সুযোগ দিয়েছেন জাতীয় দলে। এটা কেন হবে? ভারতীয় দল এমন হবে যেখানে এ রকম কোনও বাধ্যতা থাকবে না যে নির্দিষ্ট একটি রাজ্যের ফুটবলারদেরই নিতে হবে। সবাইকে সমান চোখে দেখতে হবে। যার মধ্যে কোয়ালিটি আছে তাকেই নেওয়া হোক। তাতে যদি দেখা যায় গোয়ার ছেলেদের কোয়ালিটি ভালো তা হলে তারা চান্স পাবে। আবার যদি দেখা যায় কলকাতার ফুটবলাররা ভালো, তা হলে তাদের নেওয়া হোক।”
এর পাশাপাশি আইএসএল নিয়ে অতিরিক্ত মাতামাতির বিরুদ্ধেও সরব হয়েছেন রহিম নবী। তাঁর কথায়, “কলকাতায় অনেক ভালো ভালো প্লেয়ার রয়েছে। কিন্তু তুমি যদি তাদের না দেখে শুধু আইএসএলে’র নিরিখেই দল গড়তে যাও তা হলে তো ভারতীয় ফুটবল তৈরি হবে না। তোমাকে সব লিগ দেখতে হবে। আইএসএলের পাশাপাশি কলকাতা লিগ, বেঙ্গালুরু লিগ সব দেখে বিচার করতে হবে। তা না করে তুমি যদি যাদের বয়স হয়ে গিয়েছে, সেই সিনিয়র প্লেয়ারদের নিয়েই স্বপ্ন দেখতে থাকো, তা হলে আগামী দিনে র্যাঙ্কিংয়ে ১৩৩ থেকে ১৪০ এ চলে যাবে ভারত।” নবীর ইঙ্গিতটা কাদের দিকে তা জলের মতই স্পষ্ট। তবে একটি বিষয়ে বিদেশ বসু এবং রহিম নবী দুজনেই একমত। তা হল, খালিদ জামিলের কোচিং।
মানালো মার্কেজের বিদায়ের পর সর্বভারতীয় ফেডারেশনের কাছে জমা পড়েছিল সর্বমোট ১৭০টি আবেদনপত্র। তার মধ্যে থেকে বেছে নেওয়া হয় স্বদেশি কোচ জামিলকে। দুই প্রাক্তনীই এতে উচ্ছ্বসিত। অভিজ্ঞ কোচ জামিলের বিচক্ষণতার ওপর পূর্ণ আস্থা রেখে তাঁদের আশা, এ বার হয়তো ভারতীয় দলে বেশ কয়েকটি বাঙালি মুখ দেখা যেতে পারে। যদিও এতেই অবসান ঘটে যাচ্ছে না যাবতীয় তর্কের। বাংলার ফুটবল পরিচালনার ভার যাদের কাঁধে, সেই আইএফএ ঠিক কী ভাবছে?
ফোনে যোগাযোগ করা হয়েছিল আইএফএ’র সহ সভাপতি সৌরভ পালের সঙ্গে। কিন্তু তিনি এ কথা মোটেই মানতে চাননি যে বাংলা থেকে ফুটবলার সাপ্লাইয়ে ভাটা পড়েছে। বরং ব্যখ্যা দিয়েছেন, “আদিবাসী সম্প্রদায়ভুক্ত খেলোয়াড়রা বেশি করে উঠে আসছেন। মুন্ডা, কিস্কু এই পদবিগুলিই ইদানীং বেশি দেখা যাচ্ছে। কিন্তু ঘোষ, বোস, ভট্টাচার্য অর্থাৎ চেনা বাঙালি পদবিগুলি তেমন একটা দেখা যাচ্ছে না বলেই মনে হচ্ছে বাঙালি ফুটবলারের সাপ্লাইয়ে ভাটা পড়েছে।” আরও যোগ করেছেন, “মনিপুরের সঙ্গে তুলনায় বাংলা পিছিয়ে আছে এটা ঠিক। তবে আরও একটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে, গোটা দেশে আই লিগ, আইএসএল, সব মিলিয়ে ৪০-৫০ জন বাঙালি ফুটবলার রয়েছেন। মনিপুরের ঠিক পরেই রয়েছে বাংলা। এমনকি কলকাতা লিগের ম্যাচেও দেখা যাচ্ছে যে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাঙালি ফুটবলাররাই ম্যান অফ দ্যা ম্যাচ হচ্ছেন।”
অর্থাৎ এক কথায়, নানা মুনির নানা মত। এক দিকে বিদেশ বসু, রহিম নবীর মত প্রাক্তনীরা স্পষ্টতই মেনে নিচ্ছেন যে, বঙ্গ ফুটবলের অতীতের জৌলুস আজ বাস্তবিকই লুপ্ত হওয়ার পথে। রহিম নবী তো সরাসরিই দাবি করছেন, এ রাজ্য থেকে বড়জোর একজন কি দুজনই সুযোগ পাচ্ছেন ভারতীয় দলে। তবু এর পরেও বাংলার হালফিলের ফুটবল কাঠামো নিয়ে অভিযোগ মানতে পুরোপুরি নারাজ আইএফএ’র সহ সভাপতি। এই অবস্থায় সবটা সময়ের হাতে ছেড়ে দেওয়া ছাড়া আর কীই বা করার থাকতে পারে বাংলার আপামর ফুটবলপ্রেমী জনতার? “What Bengal thinks today, India thinks tomorrow”— মহামতি গোখলের এই চিরন্তন বাণী পুনরায় সত্যি হয় কি না তা বলবে সময়ই।