রাজা বন্দ্যোপাধ্যায়
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ঘুষ কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত গৌতম আদানিকে ভারতের সরকার প্রকাশ্যে রক্ষা করছে না, আবার করছেও না কোনও কঠোর পদক্ষেপ। পাশাপাশি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প শুল্কনীতি নিয়ে যথেষ্ট কড়া পদক্ষেপ করেছেন ভারতের বিরুদ্ধে। কিন্তু আদানির বিরুদ্ধে তাঁর নিজের দেশে মামলা থাকলেও কোনও পদক্ষেপ নয় কেন?
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও শিল্পপতি গৌতম আদানির সম্পর্ক আন্তর্জাতিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। যুক্তরাষ্ট্রে আদানি গ্রুপের বিরুদ্ধে শত কোটি ডলারের ঘুষ দেওয়ার অভিযোগের মামলা দায়ের হলেও, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ এখনও নীরব। তাই প্রশ্ন উঠছে, মোদি কেন আদানিকে রক্ষা করছেন? দুজনের সখ্য শুরু গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদি দায়িত্ব পাওয়ার পর।
২০০২ সালে গুজরাত দাঙ্গার পরে, মোদি ও আদানি দুজনেই চাপের মুখে পড়েন। সেখান থেকেই শুরু ঘনিষ্ঠতা। ‘ভাইব্রান্ট গুজরাট’ সামিটে মোদির মুখ্যমন্ত্রিত্বে আদানি গুজরাতে ১৫,০০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ ঘোষণা করেন। ‘মুন্দ্রা’ বন্দরের জন্য আদানিকে বাজারমূল্যের অনেক কম দামে জমি দেন তৎকালীন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এই বিনিয়োগ মোদির “গুজরাট মডেল”-এর প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ঠিক আগে থেকেই আদানির সম্পদ জেট গতিতে বাড়তে থাকে। আদানি গ্রুপ ভারতের বৃহত্তম ‘পরিকাঠামো বিনিয়োগকারী গোষ্ঠী’ হয়ে ওঠে।
বছর দশেক নিশ্চিন্তেই চলছিল আদানি গ্রুপের ব্যবসা। ২০২৪ সালের শেষে, মার্কিন আদালতে আদানির বিরুদ্ধে মামলা হয় সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পে ঘুষ প্রদান ও অর্থ পাচারের অভিযোগে। সাগর আদানির হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাটে মেগাওয়াট অনুযায়ী ঘুষের হিসাব ছিল। ২৫০ মিলিয়ন ডলারের ওপর ঘুষ দেওয়ার অভিযোগ ওঠে আদানি গ্রুপের বিরুদ্ধে। এর ফলে আদানি গ্রুপের শেয়ার ২৭ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত ধসে পড়ে। কেনিয়া সহ বেশ কিছু দেশ আদানিদের প্রকল্প বাতিল করে দেয় আন্তর্জাতিক চাপের মুখে।
যদিও মোদি সরকার বলছে, এটি মার্কিন আইনি প্রক্রিয়া, আমাদের কোনও ভূমিকা নেই। কিন্তু এই অভিযোগ আসা সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় সরকার কোনও তদন্ত করেনি, এমনকী এই বিষয়ে কোনও মন্তব্যও করা হয়নি। আর এটাই ইঙ্গিত করছে আদানিদের প্রতি মোদির নীরব সমর্থন।
আর্থিক আনুকুল্য, নির্বাচনী সহায়তা, সংবাদ মাধ্যমের ওপর আদানি গোষ্ঠীর প্রভাব বিস্তার, সবই মোদির পক্ষে গিয়েছে আদানির কাছ থেকে। বন্ধুত্বের দায়ে দুই দশকের সম্পর্ককে এখন ‘রাষ্ট্রীয় প্রয়োজন’ হিসেবেই দেখছেন প্রধানমন্ত্রী। দেশের অর্থনৈতিক বিনিয়োগের প্রতীক আদানির পতন মানে মোদির উন্নয়ন মডেলের ওপর আঘাত। মার্কিন শুল্কনীতির পাল্টা জবাবে বিদেশি চাপের বিরুদ্ধে “ভারত কারও চাপের কাছে মাথা নত করবে না” বার্তাও এখন দিচ্ছেন মোদি, রাজনাথ, পীযূষ গোয়েল, জয়শঙ্কররা।
আদানি ও মোদির সম্পর্ক শুধুমাত্র ব্যক্তিগত সম্পর্ক বা পুঁজিপতিকে রক্ষা করা নয়, বরং এটি এক জটিল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমীকরণের বহিঃপ্রকাশ। ঠিক যে কারণে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও আদানির বিরুদ্ধে মামলা নিয়ে কোনও উচ্চবাচ্য করছেন না। দেশের অভ্যন্তরে বা বাইরে যতই অভিযোগ উঠুক, যতদিন মোদির নেতৃত্ব থাকবে, আন্তর্জাতিক অর্থনীতির স্বার্থ বজায় থাকবে, ততদিন আদানি সম্ভবত থাকবেন ‘অন্তরাল নিরাপদ অঞ্চলে’।
