বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় পারেনি, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় পেরেছে। তৃণমূল ছাত্র পরিষদের প্রতিষ্ঠা দিবসে পরীক্ষা করানো নিয়ে টালবাহানা ছিলই। কিন্তু নড়চড় হতে দেননি শান্তা দত্ত দে। ২৮ অগস্ট আবার পরীক্ষা কীসের? ছাত্রছাত্রীরা তো টিএমসিপি-র প্রতিষ্ঠা দিবস ধুমধাম করে পালন করবেন। করুন, কিন্তু পরীক্ষা হবেই। অনড় ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থায়ী উপাচার্য। সরকারের প্রচ্ছন্ন চাপের কাছেও নতিস্বীকার করেননি। পরীক্ষা হয়েছে। পালন হয়েছে টিএমসিপি প্রতিষ্ঠা দিবসও।
স্নায়ুযুদ্ধে শেষ হাসি শান্তাই হেসেছেন। পরীক্ষা করিয়ে। ওদিকে মেয়ো রোডের সমাবেশ থেকে ছাত্রছাত্রীদের উদ্দেশে বার্তাও দিয়েছেন মমতা-অভিষেক। তাদের পাশে থাকার কথাও বলেছেন। কিন্তু পরীক্ষা করানোর যে চ্যালেঞ্জ শান্তা নিয়েছিলেন, তাকে ব্যর্থ করতে পারেনি সরকার। শান্তার কথাতেই পরিষ্কার, তিনি নুয়ে পড়ার পাত্রী নন। পরিষ্কার বলছেন, আমি যখন সিন্ডিকেটের সদস্য ছিলাম, তখনকার উপাচার্যরা তো আমায় প্রতিবাদী বলে দিত। আজ আমি যখন ক্ষমতাসীন, তখন আমি সেই স্বতন্ত্রতা একেবারে প্রয়োগ করেছি। সেখানে সরকার কোনও নির্দেশ দিতে পারে না। আর তাতে মান্যতা দিয়েছে সিন্ডিকেটও। এই পরীক্ষার দিন-দ্বন্দ্বের আবহে এক শিক্ষা আধিকারিক উপাচার্যকে জানিয়েছিলেন, মুখ্যমন্ত্রী দিন বদলের জন্য ব্যক্তিগত ভাবে অনুরোধ করেছেন। তাতে শান্তা বলেন, এটা তো অসাংবিধানিক। অনুরোধ করলেন কী করে? না করলেই তো পারতেন।
শান্তা যখন এতটা ধারালো, তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্ত সুরেন্দ্রনাথ সান্ধ্য কলেজের অধ্যক্ষের কীর্তিকলাপে বিরক্ত তো হবেনই। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্ধারিত সেমিস্টার পরীক্ষার দিনেই বিতর্কের জন্ম দেন জাফর আলি আখান। বৃহস্পতিবার কলেজ চত্বরে তৃণমূল ছাত্র পরিষদের পক্ষ থেকে সদস্যদের পোশাক বিতরণ করা হচ্ছিল। ওই কর্মসূচিতেই তিনি ‘জয় বাংলা’ লেখা হলুদ পাঞ্জাবি পরে টিএমসিপি সদস্যদের পোশাক বিলি করেছেন। ছাত্রছাত্রীদের অনুরোধেই তিনি নাকি এই কাজ করেন। স্বাভাবিকভাবেই একজন অধ্যক্ষের এই আচরণ মেনে নিতে পারছেন না কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য শান্তা দত্ত দে। তিনি বলেছেন, ওঁর কাজ তো ছাত্রছাত্রীদের বোঝানো। যখন চিঠি পাঠালেন, তখনই পরিষ্কার হয়ে গেছে উনি রাজনৈতিক দোষে দুষ্ট। সরকার যা শেখাচ্ছে, তিনি সেটাই করছেন। খুব দুঃখজনক। একজন উপাচার্য হিসেবে অধ্যক্ষের এই কাজের তীব্র নিন্দা করেন শান্তা।
জাফরবাবুর কাজে অবশ্য দোষের কিছু দেখছেন না কুণাল ঘোষ। এই বিতর্কে তিনি বিজেপিকে একহাত নিয়েছেন। তাঁর দাবি, প্রত্যেক দলেরই শিক্ষক, অধ্যাপক সংগঠন আছে। তাঁরা পার্টির কর্মসূচিতে থাকেন। নাম না করে সুকান্ত মজুমদারকে কটাক্ষ করেছেন তৃণমূলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক। ছাত্র পড়িয়ে যে এমএলএ, এমপি, এমনকি মন্ত্রীও হওয়া যায়, তার উদারহণ টেনে এনেছেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ে বা শান্তা দত্তর সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনও মন্তব্য করেননি কুণাল।
তবে শান্তার বক্তব্য, পরীক্ষার দিন বদল করা মানে সরকারকে তুষ্ট করা। এই মানসিকতা থেকে উপাচার্যরা বেরিয়ে এলে শিক্ষার অনেক উন্নতি হবে। আমার বিশেষ করে ভাল লাগছে, ছেলে-মেয়েরা যখন বলছে, নির্বিঘ্নে পরীক্ষা দিয়েছে এবং আমার নাম করে ধন্যবাদ দিচ্ছে। আমি তো এটাই চেয়েছিলাম। অটোনমির ওপর সরকার হস্তক্ষেপ করছে, সেটাকে একেবারে গুরুত্ব দিতে চাইনি। আর এই পথে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সম্পূর্ণ পাশে থাকল, এটা বিশাল বার্তা গেল। তিনি বলেন, যেদিন থেকে এই পরীক্ষা নিয়ে সরকারের সঙ্গে সরাসরি স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হয়, তার আগে থেকেই আমরা পরীক্ষার দিন ঠিক করেছিলাম। কোনও পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে দিন ঠিক করা হয়নি। হঠাৎ করে ২৮ অগস্টের পরীক্ষা নিয়ে ২৫ জনের মতো ছাত্র রাতের বেলা এসে উপাচার্যের ঘরে বাকবিতণ্ডা কেন করবে। কেন তারা বলবে, তৃণমূল ছাত্র পরিষদের প্রতিষ্ঠা দিবসে পরীক্ষার দিন পরিবর্তন করতে হবে। না হলে তাদের দলের কর্মসূচিতে সমস্যা হবে। এর পর উচ্চ শিক্ষা দফতর থেকে চিঠি আসে। যেখানে লেখা ছিল ‘কেউ একজন অনুরোধ করছেন’ এই মর্মে। পরীক্ষার দিন বদলের অনুরোধ আসে। বিশেষ চিঠির বিশেষ মর্যাদা দিয়ে সিন্ডিকেট মিটিং ডাকা হয়। যেখানে উচ্চ শিক্ষা দফতরের দু-তিনজন ছিলেন। সেদিন তুমুল তর্কাতর্কি হয়। ওমপ্রকাশ মিশ্র বলতে থাকেন, এটা মুখ্যমন্ত্রীর অনুরোধ, রাখা উচিত। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে যায়, আমরা একটা ভোটাভুটি করি। তাতে সকলে নির্ভয়ে হাত তুলে আমাদের সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানান।
তৃণমূল ছাত্র পরিষদের প্রতিষ্ঠা দিবস যে সরকার বনাম শান্তা দত্ত দে হয়ে রইল, এ নিয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশই নেই।