‘রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি’ ঢাকতে ‘ভাষা-সন্ত্রাস’, ২০২৬-এর ভোটের দিকে তাকিয়ে অস্ত্রে শান শাসক ও বিরোধীর
উত্পল পট্টনায়ক
বছর ঘুরলেই পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা ভোট। স্বভাবতই ভোটারদের মন পেতে, প্রচারে নেমে পড়েছে রাজ্যের শাসক দল এবং বিরোধীরা। টানা ৩ বার জিতে আসা তৃণমূল কংগ্রেসের কাছে এবার বড় চ্যালেঞ্জ ক্ষমতা ধরে রাখা। অথচ শিক্ষা-স্বাস্থ্য-বাসস্থান থেকে শুরু করে খাদ্য বণ্টন, দুর্নীতির দায়ে কাঠগড়ায় দলের একাধিক মন্ত্রী থেকে শুরু করে নেতা ও নেত্রী।
দুহাজার ছাব্বিশের ভোটের মুখে দুর্নীতি মামলা ঘিরে নতুন করে শুরু হয়েছে ধরপাকড়। ক্রমবর্ধমান সেই চাপ কাটাতে শাসক দলের ভরসা এখন বাংলা ও বাঙালি এবং তাকে ঘিরে সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ। দলকে চাঙ্গা করতে পড়ে পাওয়া সেগুলিকেই এখন অস্ত্র করে ভোটের ময়দানে নেমে পড়েছেন শাসক দলের শীর্ষ নেতৃত্ব।
ভোটার তালিকার নিবিড় সংশোধন তথা এসআইআর ঘিরে নির্বাচন কমিশন এবং কেন্দ্রের বিজেপি সরকারকে একাসনে বসিয়ে আক্রমণ শানিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। তৃণমূল ছাত্র পরিষদের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী ঘিরে সভামঞ্চ থেকেই কমিশন ও কেন্দ্রকে দুষেছেন মমতা ও অভিষেক। ছাড় পাননি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহও।
মেয়ো রোডের মঞ্চ থেকে মুখ্যমন্ত্রী মমতার অভিযোগ, ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে এসআইআর-এর নামে বাঙালিদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। তাঁর দাবি, “ভোটার তালিকা থেকে ভোটারদের নাম মুছে ফেলার লক্ষ্যে, সারা দেশ থেকে ৫০০ টিরও বেশি দল পশ্চিমবঙ্গে মোতায়েন করেছে”। দলের কর্মী ও সমর্থকদের সতর্ক থাকতে বলেছেন, “আপনাদের অবশ্যই পরীক্ষা করতে হবে যে আপনার নাম এখনও আছে কিনা, নাকি ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। আপনার আধার কার্ড আছে কিনা তা নিশ্চিত করতে হবে।” ভোটার তালিকা ঘিরে সমীক্ষা করতে এলে বিস্তারিত তথ্য না দেওয়ার কথাও বলেছেন রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান।
এসআইআর ঘিরে রাজ্যের সরকারি কর্মকর্তাদের “ভয় দেখানোর” অভিযোগও তুলেছেন মুখ্যমন্ত্রী। বলেছেন “ইসি আমাদের কর্মকর্তাদের হুমকি দিচ্ছে। তবে মনে রাখবেন কমিশনের কাজ শুধু নির্বাচনের সময় তিন মাসের জন্য, সারা বছর নয়”। একই সঙ্গে স্মরণ করিয়েছেন, জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকারই বাকি সময় সরকারি কর্মীদের পাশে থাকে।
নাম না করেই নির্বাচন কমিশনের পদাধিকারীদের বিরুদ্ধে সরাসরি আক্রমণ শানিয়েছেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। বলেছেন, ”আমরা এই পেশিশক্তি প্রদর্শন সহ্য করব না। আপনার উপর আমাদেরও নিজস্ব প্যান্ডোরার বাক্স রয়েছে। আপনি যদি আমাদের চাপ দেন, তবে আমরা আপনার দুর্নীতি প্রকাশ করব। শুনুন, ললিপপ বাবু, আমরা জানি আপনার পরিবারের কোন সদস্য বিভিন্ন রাজ্যে আইএএস এবং আইপিএস অফিসার এবং কাদের মাধ্যমে আপনি বিজেপির জন্য এই ললিপপ ব্যবস্থা ব্যবহার করছেন”।
মুখ্যমন্ত্রী তাঁর এমন মন্তব্যকে কেবল একটি প্রাতিষ্ঠানিক লড়াই হিসেবে নয়, বরং একটি সাংস্কৃতিক লড়াই হিসেবেও বর্ণনা করেছেন। তিনি ইতিহাস তুলে ধরে দলের নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের মনে করিয়ে দিয়েছেন, “যদি বাংলা না থাকে, তাহলে জাতীয় সঙ্গীত এল কোথা থেকে। জাতীয় সঙ্গীত কোন ভাষায় লেখা? তারা (বিজেপি) চায় স্বাধীনতা আন্দোলনে বাঙালিদের ঐতিহাসিক ভূমিকা ভুলে যাক জনগণ। আমরা এই ভাষাগত সন্ত্রাস সহ্য করব না।”
বিজেপির হিন্দুত্ববাদী প্রতীক ঘিরেও কটাক্ষ করেছেন তৃণমূল সুপ্রিমো। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের সঙ্গে আপেস করার অভিযোগ তুলেছেন। বলেন, “তাদের পূর্বসূরিরা ছিলেন ব্রিটিশদের এজেন্ট”। তিনি বিনায়ক দামোদর সাভারকরের ক্ষমা প্রার্থনা নিয়ে তীব্র আক্রমণ শানিয়েছেন। কেন্দ্রের শাসক দলের “বাঙালি ভীতি” এবং “ব্যাকডোর এনআরসি” লাগু করার প্রচেষ্টার কড়া সমালোচনা করেছেন।
মুখ্যমন্ত্রীর তীব্র আক্রমণ থেকে ছাড় পাননি অমিত শাহও। বাংলাকে ঘিরে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পরিবারতন্ত্র অভিযোগ ফিরিয়ে দিতে, টেনে এনেছেন আইসিসি চেয়ারম্যান অমিত-পুত্র জয় শাহকে। বলেছেন, “অমিত বাবু, আপনি আমাদের বিরুদ্ধে পরিবারতন্ত্রের রাজনীতি চালানোর অভিযোগ করেন, কিন্তু আপনার ছেলের কী হবে, যিনি এমন একটি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতিত্ব করেন, যেখানে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা জড়িত। রাজনীতিতে এমন অর্থ নেই। এটা কি পরিবারতন্ত্র (রাজনীতি) নয়? আপনি কি এটাকে সমাজতন্ত্র বলেন?”
মমতা যখন নিজেকে গণতান্ত্রিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের রক্ষক হিসেবে উপস্থাপন করেছেন, তখন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বাংলার ভোটারদের রক্ষা করার জন্য গণসংহতির কথা বলেছিলেন। বলেছেন, “আগে ভোটাররা সরকার নির্বাচন করত, কিন্তু এখন বিজেপি অগণতান্ত্রিক SIR প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ভোটারদের নির্বাচন করছে। এর বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই অব্যাহত থাকবে।”
অভিষেক আরও বলেছেন, ”যদি বিজেপি একজন বৈধ ভোটারকে বাদ দেওয়ার সাহস করে, তাহলে আমরা প্রতিবাদে দিল্লির রাস্তায় নামব। আমরা ১০ লক্ষ বাঙালিকে নিয়ে দিল্লিতে মিছিল করব, রাজপথ ঘেরাও করব এবং আমাদের শক্তি দেখাব।” অভিষেকের দাবি, তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে শুধু অপপ্রচারই নয়, পদক্ষেপও করছে বিচার বিভাগের একটি অংশ, কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলি। কিন্তু ১০ কোটি বাঙালি তাঁদের সঙ্গে রয়েছেন। রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল বিজেপির উদ্দেশে তাঁর চ্যালেঞ্জ, ”যদি বিজেপির শক্তি থাকে, তাহলে তারা (২০২৬ সালে) ৫০টির বেশি বিধানসভা আসন পেয়ে দেখাক”।
বাংলায় এসআইআর ঘিরে দলের লড়াইকে কেন্দ্রের আইনসভার এজেন্ডার বিরুদ্ধে প্রতিরোধের সঙ্গে যুক্ত করেছেন ডায়মন্ড হারবারের তৃণমূল সাংসদ। লোকসভায় তৃণমূলের দলনেতা কেন্দ্রের প্রস্তাবিত একটি সাংবিধানিক সংশোধনী আটকাতে দলীয় সংসদদের ভূমিকার কথা গর্ব করে তুলে ধরেছেন। বলেছেন, “অমিত শাহ একটি সংশোধনী বিল এনে সংবিধান সংশোধনের চেষ্টা করেছিলেন, আমাদের ২৮ জন সাংসদ লোকসভার ওয়েলে নেমে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন। সেই প্রতিরোধের কারণেই শাহ বিলটি পেশ করতে পারেননি”।
তৃণমূল ছাত্র পরিষদের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী ঘিরে মমতা এবং অভিষেকের যাবতীয় অভিযোগ ফুৎকারে উড়িয়েছেন বিজেপি রাজ্য সভাপতি শমীক ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, “তৃণমূল কংগ্রেস জানে যে আগামী নির্বাচনে তারা পরাজিত হবে, তাই তারা বানানো গল্প তৈরি করছে। পৃথিবীর কোনও শক্তি, বাংলায় তৃণমূলকে ক্ষমতায় ফেরাতে পারবে না। বাংলার জনগণ জানেন, বিজেপিই একমাত্র বিকল্প। আর তৃণমূল একটি পারিবারিক আঞ্চলিক শক্তি, যা সমস্ত বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছে।”
পুজোর মুখে তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপির এমন বাকযুদ্ধ রীতিমতো প্রভাব ফেলছে উৎসবে মাততে চলা রাজ্যের ভোটারদের। বাঙালি অস্মিতা বনাম দুর্নীতির নাগপাশকে খুঁচিয়ে তাঁদের কাছে টানার লড়াইতে কেউই এতটুকু জায়গা ছাড়তে রাজি নয়। ছাব্বিশের ভোটের দিনক্ষণ যত এগিয়ে আসবে, ততই বাড়বে তোপ-পাল্টা তোপ, বিবৃতি আর পাল্টা বিবৃতির লড়াই।