আর্থিক সঙ্কটে পড়ে শ্রীলঙ্কার উত্তাল পরিস্থিতি জনমানসে একটু ফিকে হয়ে এলেও নেপালের সঙ্কটজনক পরিস্থিতি দেখতে দেখতে বারবার মনে পড়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের কথা। বেশি দিন তো নয়, মাত্র এক বছর আগে ২০২৪ এর ৫ অগস্ট ব্যাপক আন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রীর কুর্সি ছেড়ে দেশ থেকে পালাতে হয়েছিল শেখ হাসিনাকে। আর এই সেপ্টেম্বরেই সাধারণ মানুষের প্রবল বিক্ষোভের জেরে পদ ছাড়তে হল ভারতের আর এক পড়শি নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলিকে। তিনি দেশ ছাড়বেন কি না তা সময়ই বলবে। রিপোর্টে বলা হচ্ছে, তিনিও দেশ ছেড়ে পালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
বিপ্লবের জেরেই পতন
বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা একটা দলের বিরুদ্ধে যে কতটা ক্ষোভ দানা বেঁধেছিল তা সামনে এনে দিয়েছিল কোটা বিরোধী আন্দোলন। আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে স্বৈরাচারী আচরণের অভিযোগ ওঠে এবং শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবিতেই দেশজুড়ে আন্দোলন শুরু হয়। পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাওয়ায় সেনার নির্দেশেই পদত্যাগ করতে হয় হাসিনাকে। সেই আন্দোলনকে আজ ডাকা হয় জুলাই গণঅভ্যুত্থান বা জুলাই বিপ্লব নামে।
অন্যদিকে রাজতন্ত্রবিরোধী বিদ্রোহে নেতৃত্বের মাধ্যমেই ক্ষমতায় আসেন নেপালের আজকের বামপন্থীরা। ২০০৮ সালের মে মাসে রাজতন্ত্র বিলুপ্ত হয় এবং সম্প্রতি ক্ষমতায় থাকা কেপি শর্মা ওলি নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল তখন সেই যৌথ সরকারের অংশ হয়। এবার সেই জনতার বিদ্রোহের জেরে সেনাবাহিনীর চাপে পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন কেপি শর্মা ওলি। আজ ফের রাজতন্ত্র ফেরানোর দাবি উঠছে নেপালে।
তরুণদের নেতৃত্বেই আন্দোলন
বাংলাদেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বা ‘স্টুডেন্টস এগেইনস্ট ডিসক্রিমিনেশন’ নামে একটি ছাত্র প্ল্যাটফর্মই শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সূচনা করে। প্রবল সরকারি দমনপীড়ন সত্ত্বেও তারা পিছিয়ে যায়নি। বরং যত প্রাণহানি হয়েছে তত আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে। শেষ পর্যন্ত সফল হয় এই ছাত্র আন্দোলনই।
নেপালে বিক্ষোভের শুরুটাও এই তরুণ প্রজন্ম বা ‘জেন জেড’ দের হাতে। প্রথমে তারা সোশ্যাল মিডিয়া নিষিদ্ধ করার প্রতিবাদে রাস্তায় নামলেও পরে এই আন্দোলন শাসকের দুর্নীতি ও সরকারের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক বিদ্রোহে রূপ নেয়। প্রাণহানি সত্ত্বেও প্রতিবাদ থামেনি, বরং আরও জোরদার হয়েছে।
সুবিধাভোগীদের বিরুদ্ধেই ক্ষোভ
বাংলাদেশে আন্দোলনের কেন্দ্রে ছিল স্বাধীনতা যোদ্ধাদের বংশধরদের জন্য চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী প্রজন্মের তরুণরা মনে করত, এই ব্যবস্থা তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করছে। সুপ্রিম কোর্টের এক রায় আন্দোলনকে উসকে দেয়, যা শেখ হাসিনার পতনে পরিণত হয়।
নেপালে আন্দোলন শুরু হয়েছিল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিষেধাজ্ঞার বিরোধিতা দিয়ে। কিন্তু পরে তা রূপ নেয় দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে এক প্রবল আন্দোলনে। ‘নেপো কিডস’ হ্যাশট্যাগ ছড়িয়ে পড়ে, যেখানে অভিযোগ ওঠে যে শাসকরা বিলাসী জীবনযাপন করছে, আর সাধারণ মানুষ নিত্য প্রয়োজন মেটাতেও হিমশিম খাচ্ছে।
দমন-পীড়নেও রোখা যায়নি আন্দোলন
বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকার প্রথমে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’কে গুরুত্ব দিতে চাননি। তাঁর দমননীতিতে প্রাণ হারান অন্তত ১,৫০০ বিক্ষোভকারী। কিন্তু এই দমননীতি আন্দোলন দমাতে পারেনি। বরং সারা দেশে তা ছড়িয়ে পড়ে, আর শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীকেই পদ ছেড়ে পালাতে হয়। নেপালেও প্রথমে আন্দোলন সীমিত ছিল কাঠমান্ডুতেই। কিন্তু ওলি সরকারের অনড় মনোভাব ও কঠোর পদক্ষেপেই তা দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। দমনপীড়নে নিহত হন অন্তত তেইশ জন। প্রথমে কেপি শর্মা ওলি পদত্যাগে অনড় ছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে বাধ্য হয়েই সরে দাঁড়াতে হয়েছে।
