দোরগোড়ায় কড়া নাড়ছে দুর্গোৎসব। আর সেই আবহেই কলকাতা জুড়ে ফের শুরু হয়েছে গাছের ডাল ছাঁটাই পর্ব। কাটারি-করাত আর কুঠারের কোপে নির্মমভাবে কেটে ফেলা হচ্ছে রাস্তার দু’ধারের গাছের ডালপালা। বিলবোর্ড আর হোর্ডিং লাগানোর নাম করে নির্বিচারে সবুজ উধাও অভিযান। বৃক্ষপ্রেমীদের চিলচিৎকার, পরিবেশবিদদের ভয় ধরানো বার্তা কিংবা কলকাতা হাইকোর্টের শাস্তি, কোনও কিছুতেই এমন আত্মঘাতী কাজকর্ম বন্ধ হয়নি। নির্বিকার কলকাতা পুরসভা, উদাসীন পুলিশ প্রশাসনও।
ভরা বর্ষায় শাখা প্রশাখা মেলেছে কংক্রিটের মোড়ক ভেদ করে ওঠা এক একটা গাছ। বছরভর যানবাহনের বিষাক্ত ধোঁয়া আর ধুলোয় ঢেকে থাকা পাতাগুলো, বর্ষার পর্যাপ্ত জলে ফিরে পেয়েছে আসল চেহারা। ঝলমলে সেসব ডালেই এখন পড়ছে নির্বিচারে কোপ। অবৈজ্ঞানিকভাবে ছেঁটে ফেলা হচ্ছে শুধুমাত্র একদিকের ডালপালা। যার ফলে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে গাছের কাণ্ড আর মাটি আঁকড়ে থাকা তাদের শেকড়। ফলে একটু ঝড়বৃষ্টি হলেই গাছ উপড়ে পড়ার খবর প্রতিবারের মতো এবারও জায়গা করে নেবে সংবাদমাধ্যমে।
মহানগরীর প্রায় প্রতিটি সর্বজনীন পুজোয় খরচ মেটাতে পুজো উদ্যোক্তাদের বড় ভরসা বিজ্ঞাপন বাবদ আসা অর্থ। তাই বিলবোর্ড ও হোর্ডিং-এর ছয়লাপ পুজোমণ্ডপগুলিকে ঘিরে। প্যান্ডেলের প্রবেশপথের গাছের ডালপালা বিজ্ঞাপন দেখার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ালেই পড়ে কোপ। এর উপর নিষিদ্ধ প্লাস্টিক আর ভিনাইল দিয়ে তৈরি হোর্ডিং কিংবা ব্যানারগুলি পরিবেশের পক্ষেও ক্ষতিকর। পুজো উদ্যোক্তারা কেন এই দিকে নজর দেন না, সেই নিয়েই আক্ষেপ আর প্রশ্ন তুলেছেন এলাকার সচেতন জনগণ।
পরিবেশবিদদের বক্তব্য, গাছগুলির অসম ছাঁটাই প্রাকৃতিক ভারসাম্য ব্যাহত করে এবং তাদের দুর্বল করে দেয়। এর সঙ্গে ওই সমস্ত গাছে যত বন্যপ্রাণ আছে তা স্থানচ্যুত হয়। পাখি, কাঠবিড়ালি এবং ছোট প্রাণী তাদের ঘরবাড়ি হারায় এবং একই সঙ্গে অক্সিজেনের অভাবে দূষণও বৃদ্ধি পায়। ভিনাইল এবং প্লাস্টিকের হোর্ডিংগুলি রোদে-জলে নষ্ট হয়ে মাটিতে পড়ে। তখন মাটি এবং জল দুটোই দূষিত হয়। ফলে পুজো কমিটিগুলির কর্তারা একদিক থেকে যেমন নাগরিক নিয়মকে উপেক্ষা করছেন, অন্যদিকে হাইকোর্টের কড়া নির্দেশও মানছেন না।
বৃহত্তর কলকাতায় পুজোর মুখে এমন গাছকাটা ঘিরে কলকাতা হাইকোর্ট বেশ কয়েকবার হস্তক্ষেপ করেছে। এমনকি অবৈধভাবে কাটার জন্য শাস্তি হিসেবে দোষী কমিটিগুলিকে ৫০টি করে চারাগাছ রোপণের নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সচেতনতা ফেরেনি। আর কলকাতা পুরসভা হাইকোর্টে চাপে পড়ে জানিয়েছে, অবৈধভাবে গাছ কাটার বিষয়ে অনলাইনে যেন অভিযোগ দায়ের করেন পুরবাসিন্দারা।
পিপল ইউনাইটেড ফর বেটার লিভিং ইন ক্যালকাটা (পাবলিক)-র কর্তা বলেছেন, “যদি আমার এক হাত এবং এক পা কেটে ফেলা হয়, আমি বেঁচে থাকতে পারি, কিন্তু আমি দাঁড়াতে পারব না। গাছগুলিরও একই পরিণতি হয় প্রায় প্রতি বছর। কংক্রিটের আধিক্যে শিকড় আটকে যাওয়া গাছগুলি একদিকে ঝুঁকে থাকায় ঘূর্ণিঝড় হলেই উপড়ে পড়ে।”
পরিবেশ আন্দোলনের চেনা মুখ সুভাষ দত্ত দাবি করেছেন, গ্রামগুলিতে হওয়া ঘূর্ণিঝড়ে কলকাতা বা হাওড়ার তুলনায় অনেক কম গাছ উপড়ে পড়ে। আর এখানে অজস্র হোর্ডিং আর ফেস্টুন গাছগুলিকে ক্রমশই দুর্বল করে তোলে।
সব খারাপের মধ্যেও আশার আলো দেখিয়েছে কলকাতার বেশ কিছু পুজো কমিটি। গত কয়েক বছর ধরে পরিবেশবান্ধব সবুজ পুজোর দিকে তাঁরা ঝুঁকেছেন। ফলে ওই সব এলাকায় বৃক্ষছেদন নৈব নৈব চ। কেএমসি এই সমস্ত সর্বজনীন পুজো কমিটিকে যত গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরবে, ততই বাড়বে পরিবেশ ঘিরে সচেতনতা। তখন হাল ফিরবে মহানগরী কলকাতার।