লাল গ্রহ মঙ্গলেও ছিল প্রাণের স্পন্দন। নাসার রোভার পার্সিভেরেন্স সম্প্রতি জেজেরো গহ্বর থেকে যে নুমনা সংগ্রহ করেছে, তারই বিশ্লেষণে উঠে এসেছে এমন উজ্জ্বল সম্ভাবনা। জেজেরো গ্রহ্বরের নমুনায় মিলেছে ভিভিয়ানাইট এবং গ্রেগাইট নামে দুটি খনিজ পদার্থ। গবেষকরা বলছেন, এই খনিজ পদার্থগুলি জীবাণু কার্যকলাপ (microbial activity) প্রতিফলিত করতে পারে।
জেজোরো গহ্বর বা জেজোরো ক্রেটার হল মঙ্গল গ্রহের একটি সুবিশাল (৪৯ কিলোমিটার ব্যাসের) গহ্বর। যা একটি গ্রহাণু বা অন্য কোনও মহাজাগতিক বস্তুর সঙ্গে সংঘর্ষের ফলে তৈরি হয়েছিল লাল গ্রহের পিঠে। এই জায়গাটি মঙ্গল গ্রহের উত্তর গোলার্ধের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত এবং এখানে একসময় নদী ও বদ্বীপ ছিল বলে বিজ্ঞানীরা মনে করছেন।
নাসার পার্সিভেরেন্স রোভার মঙ্গল গ্রহের জেজোরো গহ্বর অঞ্চলে প্রাণের অস্তিত্বের সন্ধান করছে সেই ২০২১ সাল থেকে। সম্প্রতি তাদের সংগৃহীত নমুনা থেকে দুটি খনিজ পদার্থ (ভিভিয়ানাইট এবং গ্রেগাইট) মেলায় প্রাণের অস্তিত্বের তত্ত্ব আরও জোরাল হয়েছে। নাসার বিজ্ঞানীদের দাবি, তাদের ছয় চাকার রোভারের আবিষ্কার, পৃথিবীর প্রতিবেশী গ্রহটিতে একসময় প্রাণ থাকার সম্ভাবনা সম্পর্কে আজ পর্যন্ত পাওয়া সেরা প্রমাণগুলির মধ্যে একটি।
নাসার ভারপ্রাপ্ত প্রশাসক শন ডাফি বলেছেন, তাঁরা গত এক বছর ধরে সমস্ত তথ্যের খুঁটিনাটি পরীক্ষা করেছেন। দাবি করেন, মঙ্গল গ্রহে যে প্রাণের সন্ধান চালানোর প্রক্রিয়া চলছে, তার মধ্যে এবারেই সবচেয়ে স্পষ্ট লক্ষণ ধরা পড়েছে। যা তাঁদের কাছে অবিশ্বাস্যভাবে উত্তেজনাপূর্ণ।
নাসা শিলাটির একটি ছবিও প্রকাশ করেছে। একটি খুব সূক্ষ্ম দানাদার, মরিচা-লাল কাদা পাথর, যার মধ্যে চিতাবাঘের গায়ের দাগের মতো বলয় আকৃতির বৈশিষ্ট্য ধরা পড়েছে। রয়েছে পোস্ত বীজের মতো কালো দাগও। গবেষকদের মতে, জীবাণু জড়িত রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে শিলাটি তৈরি হওয়ার সময় এই বৈশিষ্ট্যগুলি তৈরি হতে পারে। একই সঙ্গে জানানো হয়েছে, সংগৃহীত শিলায় জীবনের অনুপস্থিতি বা উপস্থিতি সম্পর্কে সিদ্ধান্তে পৌঁছনোর আগে আরও তথ্য বা আরও বিশ্লেষণ প্রয়োজন।
নাসার বিজ্ঞান মিশন ডিরেক্টরেটের সহযোগী প্রশাসক নিকি ফক্স বলেছেন, তাঁদের বিজ্ঞানীরা কোনও জীবন্ত প্রাণী আবিষ্কারের ঘোষণা কিন্তু করেননি। কারণ শিলাটি “নিজেই জীবন নয়”। নাসার রোভার পার্সিভেরেন্স, তার অনবোর্ড যন্ত্রগুলির সাহায্যে গহ্বরের শিলা এবং কিছু লুজ মেটেরিয়াল (রেগোলিথ)কে বিশ্লেষণ করেছে এবং তারপর নমুনা সংগ্রহ করে রোভারের ভিতরে সংরক্ষিত টিউবে সিল করে রেখেছে।
রোভার পার্সিভেরেন্সের সংগৃহীত নমুনার ছবি ও তথ্য বিশ্লেষণ করে নাসার বিজ্ঞানীরা বলেছেন, ভিভিয়ানাইট হল লোহা এবং ফসফরাস ধারণকারী একটি খনিজ। আর গ্রেগাইট লোহা এবং সালফারের মিশ্রণে খনিজ পদার্থ। লাল গ্রহের হ্রদের তলদেশে রাসায়নিক যৌগগুলির বিক্রিয়ায় তৈরি হয়েছে এই দুটি খনিজ পদার্থ। দুটি খনিজই জীবাণুর কার্যকলাপ দ্বারা চালিত হয়।
নাসার মুখপাত্র হুরোউইটজ বলেছেন, “জীবাণুগুলি এই পরিবেশে জৈব পদার্থ গ্রহণ করছে এবং তাদের বিপাকের উপজাত হিসাবে এই নতুন খনিজ তৈরি করছে”। রোভারের যন্ত্রগুলি আবিষ্কার করেছে যে, শিলাটি জৈব কার্বন, সালফার, ফসফরাস এবং লোহাতে সমৃদ্ধ। এটি জারিত আকারে, মরিচাও রয়েছে। রাসায়নিক যৌগের এই সংমিশ্রণটি, জীবাণু বিপাকের জন্য শক্তির একটি সমৃদ্ধ উৎস হতে পারে।
শুধুমাত্র রোভারের তথ্যের ভিত্তিতে এমন সিদ্ধান্তে উপনীত হতে রাজি নন নাসার বিজ্ঞানীরা। তাঁরা পার্সিভেরেন্সের সিল করে রাখা নমুনা পৃথিবীতে ফিরিয়ে এনে আরও পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাতে চান। তবে সেটার পথে বড় বাধা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বর্তমান বাজেট বরাদ্দ। আগের তুলনায় ট্রাম্পের আমলে মঙ্গল গ্রহ অভিযানের খরচ বেশ কিছুটা কাটছাঁট করতে হয়েছে নাসাকে। স্থগিত রাখতে হয়েছে নমুনা ফেরতের অভিযানও।
নাসার ভারপ্রাপ্ত প্রশাসক ডাফি বলেছেন, ”নাসা তাদের মঙ্গলে থাকা সম্ভাব্য নমুনা পুনরুদ্ধারের বিভিন্ন উপায় পরীক্ষা করছে এবং মঙ্গল গ্রহে আরও বিশ্লেষণের জন্য সরঞ্জামও পাঠাবে।” বলেছেন, “আমরা আমাদের বাজেট এবং সময় পর্যালোচনা করব, কীভাবে আমরা অর্থ সংগ্রহ করি এবং নমুনা দ্রুত ফিরিয়ে আনতে পারি তাও দেখব”।
