অনন্ত কাল থেকে বর্তমান যুগ পর্যন্ত ভারতবর্ষে যখন সূর্যোদয়ের সঙ্গে শুরু হয় কর্মজীবনের আবির্ভাব, ঠিক তখনই প্রতিটি কারিগর, স্থপতি ও শ্রমিকের অন্তরে জাগে এক অনন্য শ্রদ্ধার ভাবনা। এই শ্রদ্ধার কেন্দ্রে স্থান করে আছেন বিশ্বকর্মা, যিনি সৃষ্টির মহামঞ্চে ব্রহ্মাণ্ডের প্রথম স্থাপত্য নির্মাণ করেছিলেন। দেবসমাজের শিল্পশক্তির অধিপতি তিনি। বিশ্বকর্মার অস্তিত্ব শুধু স্থাপত্য নির্মাণেই সীমাবদ্ধ নয়, তিনি ব্রহ্মাণ্ডের সর্বোচ্চ শিল্পী, যন্ত্রবিশারদ ও অলৌকিক প্রযুক্তির স্রষ্টা। পুরাণমতে, ভাস্কর্যশিল্পের অতলজ্ঞান দ্বারা তিনি নির্মাণ করেছেন মহাকায় স্থাপত্য ও অস্ত্রশস্ত্র। ইন্দ্রের বজ্র, শিবপতির ত্রিশূল, পার্বতীর মণিমালা, এমন কত অনন্য অস্ত্র তার নির্মাণকর্মের সাক্ষ্য বহন করে। সমুদ্র মন্থনের ঘটনায় দেব-অসুরদের সংঘর্ষের প্রেক্ষাপটে বিশ্বকর্মা তার অলৌকিক শিল্পগুণে তৈরি করেন মহাজাগতিক যন্ত্রপাতি, যেগুলি দিয়ে দেবসমাজের শক্তি ও ক্ষমতা অটুট হয়ে ওঠে।
বিশ্বকর্মা পূজার দিনটি সেই প্রাচীন কালের মহাকাব্যের পুনর্জীবন। সূর্যোদয়ের প্রথম আলো যখন কারিগরদের হাত ছুঁয়ে দেয়, তখন তারা তাদের কর্মস্থল, যন্ত্রপাতি ও সৃষ্টিকর্মকে পূজা করেন। এটি কোনও নিয়মকানুন নয়, বরং এক আধ্যাত্মিক প্রতিজ্ঞা। পুরাতন কালের থেকে প্রাপ্ত সেই অমৃতময় ঐতিহ্য যেন বর্তমান প্রজন্মকে নতুন সৃষ্টির প্রেরণা জোগায়।
পৌরাণিক কাহিনিগুলি বলছে, একবার মহাদেব বিশ্বকর্মার কাছে প্রার্থনা করেছিলেন স্বর্ণপ্রাসাদ নির্মাণের জন্য। বিশ্বকর্মা নির্মাণ করেন স্বর্ণপ্রাসাদ, যার আলোকচ্ছটা তৎকালীন তিন লোক ধ্বংস করে দিতে সক্ষম ছিল। সেই মহামণ্ডিত প্রাসাদ পরে রাক্ষসরাজ রাবণের হাতে চলে যায়, যা হয়ে ওঠে লঙ্কার অতুলনীয় সৌধ।
তদ্ব্যতীত, দ্বারকা, ইন্দ্রপ্রস্থ ও হস্তিনাপুরের অপূর্ব স্থাপত্যকর্মও বিশ্বকর্মার হাতের ছোঁয়ায় রচিত। সমুদ্রগর্ভ থেকে উদ্ভূত কান্তিমানায়, স্বর্ণিত প্রাসাদ ও অভেদ্য মন্দির, সব কিছু তার অপার জ্ঞানের সৃষ্টিফল। এই কারণে প্রতিটি কারিগর ও স্থপতির মনে বিশ্বকর্মার প্রতি এক অবিচল বিশ্বাস জাগ্রত।
বিশ্বকর্মা পূজার দিন আকাশে ঘুড়ি উড়ে, মেঘপুঞ্জিত বাতাসে শিল্প ও প্রযুক্তির অমরতা উদযাপিত হয়। প্রত্যেক কর্মস্থলে যেন ঈশ্বর শিল্পীর স্পর্শ থাকে। কারিগরেরা যন্ত্রের সামনে পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ করে নতুন সৃষ্টির প্রেরণার সংকল্প গ্রহণ করেন। প্রতিটি পল, প্রতিটি বল, প্রতিটি যন্ত্রাংশ যেন বিশ্বকর্মার অলৌকিক প্রজ্ঞার অংশ হয়ে ওঠে।
এই দিনে শিল্পশক্তির পূজা মহাজ্ঞানের আরাধনা। শ্রমিক, স্থপতি, প্রযুক্তিবিদ ও যন্ত্রপ্রেমীদের মনে হয়ে ওঠে এক মহামন্ত্র। তাদের মনে জাগে বিশ্বকর্মার আদর্শ, যিনি শিল্পের পবিত্রতায় ব্রহ্মাণ্ডের সুষম নিয়ম প্রতিষ্ঠা করেছেন। আধুনিক প্রযুক্তির যুগেও বিশ্বকর্মা পূজার তাৎপর্য অটুট। প্রতিটি প্রযুক্তি আবিষ্কার, প্রতিটি যন্ত্রের কার্যকারিতা যেন বিশ্বকর্মার অনন্ত প্রজ্ঞার প্রতি শ্রদ্ধার প্রকাশ।
বিশ্বকর্মার সৃষ্টিশক্তির অমর প্রেরণায় আজকের সমাজ গড়ে তোলা হয়েছে। এই পূজা আমাদের শিক্ষা দেয়, সৃষ্টি ও শ্রমের সম্মিলনে মানবসভ্যতার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। বিশ্বকর্মার আশীর্বাদিত প্রতিটি যন্ত্রপাতি ও সৃষ্টিকর্ম যেন আমাদের ভবিষ্যতের নির্মাণশক্তিকে সমৃদ্ধ করে। পবিত্র এই দিনে বিশ্বকর্মার মহাজ্ঞান আর কল্পনার অমৃতধারা আমাদের মনে অক্ষয়
হয়ে প্রবাহিত হোক।