দিব্যেন্দু মজুমদার, হুগলি
হুগলির বলাগড় এলাকার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে শুধুই রয়েছে ইতিহাসের হাতছানি। এই এলাকার ইতিহাস নিয়ে সেরকমভাবে কোনদিনই চর্চা হয় নি। ইতিহাসের অনেক অজানা তথ্যই লুকিয়ে আছে এই বলাগড় অঞ্চল জুড়ে। এক সময় হুগলি জেলার বলাগড়, জিরাট, বেহুলা, বাকুলিয়া, সোমরাবাজার সহ বিভিন্ন অঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্ম বিস্তৃতি লাভ করেছিল এটা অনেকেরই অজানা। তবে সম্প্রতি ওইসব অঞ্চলের বিভিন্ন পুরনো বাড়িতে বসবাসকারী মানুষের কাছ থেকে বহু মূল্যবান পুঁথি সংগ্রহ করে ইতিহাসের মূল্যবান তথ্যের সন্ধানে জিরাটের বিজয়কৃষ্ণ মহাবিদ্যালয়ের অধ্যাপক পার্থ চট্টোপাধ্যায় নিরলস চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বর্তমানে সেই মূল্যবান পুঁথিগুলি জিরাট কলেজে একটি ডিসপ্লে বক্সের মধ্যে অত্যন্ত সযত্নে সংরক্ষণ করা হয়েছে। পার্থবাবু সহ বলাগড়ের বহু বুদ্ধিজীবী মানুষ দাবি করেছেন তাদের ওই অঞ্চলের একটি ঐতিহ্যশালী ইতিহাস রয়েছে যা ওই পুঁথিগুলোতে লেখা বিষয়বস্তু থেকে পরিষ্কার। তাদের দাবি এরকম আরো বহু পুঁথি এই অঞ্চল থেকে পাওয়া যাবে যা আগামী দিনে বলাগড়ের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করবে।
অধ্যাপক পার্থ চট্টোপাধ্যায় জানান করোনাকালে লকডাউন শুরু হওয়ার আগে বলাগড়ের তেঁতুলিয়া গ্রামের সৈকত ভট্টাচার্য নামে এক ব্যক্তি তাকে একটি ব্যাগ ভর্তি করে বেশ কিছু পুঁথি দিয়ে বলেন এগুলো তার বাড়ির মাচায় রাখা ছিল। আর রাখা যাচ্ছে না। যদি এটা কোন কাজে লাগে সেই মনে করেই এই পুঁথিগুলো তিনি পার্থবাবুকে দিতে এসেছেন। পার্থবাবু পুঁথিগুলির বিষয়বস্তু দেখে রীতিমতো বিস্মিত হয়ে যান। এরপর লকডাউনের সময় বলাগড়ের বিভিন্ন অঞ্চলে অসহায় মানুষদের কাছে ত্রাণ পৌঁছে দিতে মানুষের দরজায় পৌঁছে যাওয়ার পাশাপাশি পুরনো বাড়িগুলি থেকে পুঁথি সংগ্রহ করা শুরু করেন। আর সেই পুঁথির বিষয়বস্তু থেকে উদ্ধার হয় যে একসময় এই বলাগড়ের বিভিন্ন প্রান্তে মহাজনী বৌদ্ধদের বাস ছিল। উদ্ধার হওয়া এইসব পুঁথির সংখ্যা বর্তমানে আড়াই হাজার ছাড়িয়েছে। বেশ কিছু পুঁথি ভুর্জ পত্রের উপর লেখা যা দেখে অনুমান করা যেতে পারে ৩০০ বছর বা তারও আগে এই পুঁথিগুলি লেখা হয়েছিল। পুঁথিগুলির অনেকগুলিতে দুর্গাপুজো কেন্দ্রিক পুজো পদ্ধতি নিয়ে লেখা যেখানে ৬৪ লক্ষ যোগিনী পূজার উল্লেখ রয়েছে। প্রসঙ্গত মহাজনী বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মানুষই এই যোগিনী পুজো করত। তাই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে আজ থেকে বহু বছর আগে বলাগড়ের এই সকল অঞ্চলে কি তবে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বাস ছিল? এই বলাগড়ের জিরাটের পাটুলীতে একটি মঠ বাড়ি রয়েছে যার আনুমানিক বয়স ৪০০ বছরের বেশি। এখনো এই বাড়িটির দুর্গা দালানের দুই ধারে দু’টি কুলুঙ্গিতে প্রায় আড়াই ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট দু’টি ধ্যানমগ্ন বুদ্ধের মূর্তি রয়েছে। এই বাড়ির সদস্যদের কাছ থেকে জানা যায় মূর্তিটি কবেকার তা তারা জানেন না। প্রত্যেক বছর বিশেষ পুঁথি অনুযায়ী তাদের এখানে দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে যোগিনী পুজো হয়ে থাকে। এখানে তাদের মা দুর্গার দু’টি হাত দেখতে পাওয়া গেলেও বাকি আটটি হাত লুকোনো থাকে। কিন্তু যেহেতু মহাজনী বৌদ্ধদের মধ্যে যোগিনী পুজোর রীতি প্রচলিত রয়েছে তাই মনে করা হয় এক সময় বৌদ্ধরা এই পুজোর প্রচলন করেছিলেন।
পাশাপাশি উদ্ধার হওয়া এই পুথিগুলির মধ্যে নব্বই ভাগ দেবনাগরিতে লেখা, কিছু সংস্কৃত এবং কিছু বাংলা ভাষায় লেখা। পুঁথিগুলির মধ্যে অনেকগুলি সম্পূর্ণ আকারে পাওয়া গিয়েছে। আর বেশ কিছু পুঁথি অসম্পূর্ণ যার প্রথম ও শেষ পাতা পাওয়া যায় নি। কবি ভারতচন্দ্র ১৭৫৫-য় মারা যান। তার লেখা অন্নদা মঙ্গল কাব্য কারো অজানা নয়। কিন্তু তার পরেও এই বলাগড়ের কোন কবি অন্নপূর্ণা পুজোকে কেন্দ্র করে একটি পাঁচালী কেন্দ্রিক মঙ্গলকাব্য লেখা শুরু করেছিলেন। কিন্তু সেই লেখাটা তিনি সম্পূর্ণ করে যেতে পারেন নি। সেই পুঁথিটিও বলাগড়ের একটি প্রাচীন বাড়ি থেকে উদ্ধার করেছেন পার্থ বাবু। তিনি জানান বলাগড়ের বিভিন্ন অঞ্চল জুড়ে ইতস্তত ছড়িয়ে রয়েছে বহু ঐতিহ্য, বহু ইতিহাস যা এই পুঁথিগুলো থেকে জানা যায়। এছাড়া এখনো বহু পুরোনো বাড়িতে বহু পুঁথি রয়েছে যা তারা সংগ্রহ করার চেষ্টা করছেন। আর এই সকল পুঁথিগুলি উদ্ধার হলে তা থেকে অনেক অজানা তথ্য বেরিয়ে আসতে পারে যার দৌলতে আগামী দিনে বলাগড় ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিতে পারে।
বর্তমানে ওই অধ্যাপক এশিয়াটিক সোসাইটির বিবেকানন্দ বন্দোপাধ্যায় ও বিশিষ্ট পদার্থবিদ তথা পুঁথি গবেষক সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের সহযোগিতায় প্রায় সাড়ে ৭০০ পুঁথির ক্ল্যাসিফিকেশন করেছেন। আপাতত পুঁথিগুলো জিরাটের বিজয়কৃষ্ণ মহাবিদ্যালয়ের মিউজিয়ামে কাঁচের ডিসপ্লে বক্সে সংরক্ষণ করা হয়েছে। এখনো বহু পুঁথির ক্ল্যাসিফিকেশনের কাজ করা বাকি রয়েছে। সেগুলি ক্ল্যাসিফিকেশনের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন পার্থ বাবু। এলাকার বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের দাবি যদি আগামী দিনে এই ইতিহাসের অন্বেষণে সঠিকভাবে খোঁজ চালানো হয় তবে বলাগড় ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নেবে।
