স্নিগ্ধা চৌধুরী
সুকান্ত মজুমদারের পর শমীক ভট্টাচার্যই বঙ্গ বিজেপির সভাপতি হতে চলেছেন। বুধবার দুপুরেই তাঁর কাছে দিল্লির নেতৃত্বের সবুজ সঙ্কেত এসে পৌঁছয়। জানানো হয়, মনোনয়ন জমা করুন। আমরা পাশে আছি। তার পরেই খেলার ভাগ্য এক প্রকার স্থির হয়ে যায়। বাকিটা ঔপচারিকতা।
দলের ‘এক ব্যক্তি, এক পদ’ নীতির কারণে বহুদিন ধরেই রাজ্য বিজেপির নেতৃত্বে পরিবর্তনের সম্ভাবনা ছিল। বর্তমান রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার একই সঙ্গে লোকসভার সাংসদ তথা কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী। ফলে তাঁর পক্ষে দুই (তর্কসাপেক্ষে তিন) দায়িত্ব সামলানো কঠিন হয়ে পড়ছে। বিজেপির সংবিধানেও এমন কিছুর অনুমোদন নেই। এই পরিস্থিতিতে নতুন সভাপতি হিসেবে শমীক ভট্টাচার্য শীর্ষে।
দলীয় সূত্র জানাচ্ছে, ২ জুলাই রাজ্য সভাপতি পদের মনোনয়ন জমা নেওয়া হবে এবং ৩ জুলাই ফলাফল ঘোষণা করা হতে পারে। এই সময়ের মধ্যেই আনুষ্ঠানিক ঘোষণা হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। তবে এখনই নাম ঘোষণা না করলেও, জল্পনা বলছে, শমীকই হতে পারেন বিজেপির নতুন বঙ্গপ্রধান।
শমীক ভট্টাচার্যের রাজনৈতিক যাত্রা দীর্ঘ। জন্ম ৫ নভেম্বর ১৯৬৩, কলকাতার এক মধ্যবিত্ত পরিবারে। পিতার নাম সৈবীশ ভট্টাচার্য এবং মাতার নাম রুবি ভট্টাচার্য। শিক্ষাজীবন শুরু কলকাতার সুরেন্দ্রনাথ কলেজে। সেখান থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক। ছাত্রাবস্থাতেই আরএসএস-এ যুক্ত হন। হাওড়ার মন্দিরতলা এলাকায় একটি আরএসএস শাখায় যাতায়াত করতে করতেই তাঁর গৈরিক রাজনীতিতে হাতেখড়ি। সংগঠনের শৃঙ্খলা, আদর্শ ও জাতীয়তাবাদ তাঁকে প্রভাবিত করে। সেই সূত্রে শমীক যুক্ত হন ভারতীয় জনতা পার্টির সঙ্গে। ধীরে ধীরে উঠে আসেন রাজ্য রাজনীতির সামনে।
২০১৪ সালে বসিরহাট দক্ষিণ বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে বিজেপির টিকিটে জিতে বিধায়ক হন শমীক। এই জয় ছিল বিজেপির কাছে ঐতিহাসিক, কারণ দীর্ঘ সময় পর রাজ্যে আবার বিজেপির একজন বিধায়ক নির্বাচিত হল। তবে ২০১৬ সালে ওই আসনেই তিনি পরাজিত হন। এর পর ২০১৯ ও ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটেও প্রার্থী হন, কিন্তু জিততে পারেননি। তবে সংগঠনে তাঁর গুরুত্ব কমেনি। বরং সাহিত্যানুরাগী শমীকের শব্দচয়ন, বাগ্মিতা, মিডিয়া সামলানোর দক্ষতা ও রাজনৈতিক বিশ্লেষণ ক্ষমতার কারণে তিনি হয়ে ওঠেন বঙ্গ বিজেপির প্রধান মুখপাত্র। ২০২০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত এই দায়িত্বেই। ২০২৪ সালের ৩ এপ্রিল রাজ্যসভায় সাংসদ হিসেবে মনোনীত হন শমীক। রাজ্যসভায় তাঁর বক্তৃতা ইতিমধ্যেই সুনাম কুড়িয়েছে। রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, দুর্নীতি, কেন্দ্রীয় প্রকল্পে তৃণমূলের অনিয়ম থেকে তসলিমা নাসরিনের কলকাতায় ফেরা— শমীকের ক্ষুরধার বক্তৃতা ভোলার নয়। সম্প্রতি ভারতীয় সংসদীয় প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে শমীক বিদেশ সফরে গিয়েছিলেন। লন্ডন, প্যারিস, ব্রাসেলস, কায়রো ও কোপেনহাগেনে বিভিন্ন কূটনৈতিক মঞ্চে ভারতের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান তুলে ধরেন। লন্ডনে বলেন, “ভারত কখনও গরিব ছিল না। উপনিবেশিক লুটই আমাদের পিছিয়ে দিয়েছে।” ব্রাসেলসে সন্ত্রাসবাদ নিয়ে কড়া বার্তা দিয়ে বলেন, “সন্ত্রাসের আশ্রয়দাতাদের সঙ্গে সংলাপ হতে পারে না।”
এই সফরে তাঁর বক্তব্য কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের নজরে আসে। দলের শীর্ষ নেতৃত্ব মনে করছে, একজন নেতার মধ্যে আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি, রাজ্য রাজনীতির অভিজ্ঞতা এবং সাংগঠনিক দক্ষতা থাকা জরুরি, যা শমীকের মধ্যে রয়েছে। একই সঙ্গে বঙ্গ বিজেপির একমাত্র নেতা যার ভাবমূর্তি শহুরে বাঙালির। বাগ্মী শমীকের একটা গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে শহুরে বাঙালি সমাজে। যা বঙ্গ বিজেপিতে বিরল। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পার্টির প্রতি শমীকের প্রশ্নাতীত আনুগত্য।
তবে বিতর্ক থেকেও মুক্ত নন শমীক। ২০১৭ সালে প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার দুর্নীতি মামলায় সিআইডি তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকে। এক মহিলাও একবার তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিলেন। যদিও কোনও অভিযোগই প্রমাণিত নয়। দলীয়স্তরে শমীক একজন গ্রহণযোগ্য নেতা। তাঁর সঙ্গে সংঘাত নেই কারও। রাজ্য বিজেপির অনেকেই মনে করছেন, তৃণমূলের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক লড়াইয়ে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে পারবেন শমীকই। অনেকেই আবার মনে করছেন, বঙ্গ বিজেপির অন্যতম নেতা তথা রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী যে ভাবে খোলাখুলি হিন্দুত্বের লাইন আঁকড়ে বিধানসভার লড়াইয়ে বাজিমাত করতে চাইছেন, তার উল্টো দিকে তুলনায় লিবারাল মুখ হিসেবে পরিচিত শহুরে-সুবক্তা শমীককে রাজ্য সভাপতি করে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সম্ভবত ব্যাল্যান্সের বার্তা দিল।
