লাল রঙের গোল গলা সাদামাটি গেঞ্জি। খয়েরি রঙের প্যান্ট। মিছিলের সামনে হনহন করে হাঁটছে। নাম জেহাদ হোসেন ওবামা। কত আর বয়স! বছর পাঁচেক হবে। এই দেশ। এই দেশের মানুষ। ছিটমহল। ভারত বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় চুক্তি। এত কিছু বোঝার বয়স তখনও হয়নি জেহাদের। এসব কথা ২০১৫ সালের। সেই বছরই ৩১ জুলাই মধ্যরাতে ‘স্বাধীনতা’ পেয়েছিল তৎকালীন ছিটমহলের বাসিন্দারা। দেশের মানচিত্র থেকে চিরদিনের মতো মুছে গিয়েছিল ছিটমহল নামটা।মুছে গেল সেই যন্ত্রণাকর অধ্যায়। সত্যিই কি মুছল?
মধ্যমশালডাঙা, বত্রিগছ, কচুয়া সহ আরও যত ছিট ছিল ভূখণ্ডে সেখানকার বাসিন্দারা পেয়েছিলেন তথাকথিত স্বাধীনতার স্বাদ। মধ্যরাতে উড়েছিল জাতীয় পতাকা।আর সেদিন এত আনন্দ উচ্ছাসের মধ্যমণি ছিল এই জেহাদ আলি ওবামা। কে এই জেহাদ? কী তার কাহিনি? এখন সে কোথায় থাকে? ছিটমহল বিনিময়ের দশ বছর পূর্তিতে তারই খোঁজ নিল জাজবাত বাংলা। ফিরে দেখা ছিটমহল।
২০১০ সালের মার্চ মাস। কোচবিহারের দিনহাটা মহকুমা হাসপাতালে জন্ম হয়েছিল জেহাদের। বাবা শাহজাহান আলি। আর মা আসমা বিবি। আর এই জন্মের সঙ্গেই জড়িয়ে গিয়েছে অনেক কথা। অনেক লড়াইয়ের কথা। মাথা উঁচু করে নিজের পরিচয় দেওয়ার কথা। নাগরিকত্বের লড়াইয়ের সেই কথা আজও মুখে মুখে ফেরে এই বাংলায়। আসলে ছিটমহল বিনিময়ের আগে পর্যন্ত তৎকালীন ছিটমহলের বাসিন্দারা ছিলেন কার্যত নেই রাজ্যের বাসিন্দা। তাঁদের জন্য পঞ্চায়েত, থানা, রাস্তা, সরকারি আমলা, ভোটার কার্ড, ভোটদান, সরকারি সহায়তা, বিদ্যুৎ, স্কুল কিছুই ছিল না। একেবারে পরিচয়হীন হাজার হাজার মানুষ। সেখানকার কোনও মহিলাকে সন্তানের জন্ম দেওয়ার জন্য দাই-মায়ের উপর নির্ভর করতে হত। ছিটমহলের গণ্ডী পেরিয়ে কোচবিহারের দিনহাটা মহকুমা হাসপাতালে আসতেও ভরসা পেতেন না প্রসব যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকা মা। সরকারি হাসপাতালে এলে ঠিক কী পরিচয় দেবেন তাঁরা? তাঁরা তো তখন নাগরিকত্বহীন। ছিটের বাসিন্দাদের বাঁকা চোখে দেখতেন মূল ভূখণ্ডের মানুষরা। ‘আমরা ইন্ডিয়ান, ওরা ছিট’। এভাবেই গঞ্জনা শুনতে হত তৎকালীন ছিটমহলের বাসিন্দাদের।
২০১০ সাল। প্রসবকালীন জটিলতা নিয়ে মধ্যমশাল ডাঙার তৎকালীন ছিটমহল থেকে ভারতের মূল ভূখণ্ড কোচবিহারের দিনহাটার মহকুমা হাসপাতালে ভর্তি হতে এসেছিলেন আসমা বিবি। বাড়ি থেকে দিনহাটার দূরত্ব খুব বেশি নয়। তবুও যেন অনেক ক্ষেত্রেই যোজন দূরত্ব। আসলে আবার মা হবেন আসমা বিবি। আর সেটা এবার সরকারি হাসপাতালে। যেটা সেই সময় ভাবতেই পারতেন না তৎকালীন ছিটের বাসিন্দারা। শুরু হল শেকল ভাঙার লড়াই। আসমা ভর্তি হলেন দিনহাটার সরকারি হাসপাতালে। সেই সময় অভিযোগ, তাঁকে প্রাথমিকভাবে ভর্তি নিতে চায়নি সরকারি হাসপাতাল। তবুও জয় হল মানবিকতার। জন্ম হল শিশুর। কিন্তু জন্ম পরিচয়পত্রে কী লেখা হবে? কিন্তু ছিটমহলের ঠিকানায় কি জন্ম পরিচয়পত্র হতে পারে? এতদিন তো ছিটমহলের কোনও ছাত্রছাত্রী স্কুলে ভর্তি হতে গেলেও নকল বাবা মা জোগাড় করত মূল ভূখণ্ডের। এবার কি নকল ঠিকানা দেবেন আসমা?
তবে সেদিন আসমার পাশে দাঁড়ালেন তৎকালীন ছিটমহলের বাসিন্দারা। তাঁরা একযোগে বললেন, ছিটমহলের ঠিকানাই লিখতে হবে জন্মের পরিচয়পত্রে। আমরা তো কোন অপরাধ করিনি। আমরাও মানুষ।আর শিশুর নাম হবে জেহাদ হোসেন ওবামা।
এরপর তোর্ষা দিয়ে অনেক জল বয়ে গিয়েছে। সেই ছিটমহল এখন সাবেক ছিটমহল। কেমন আছে সেই জেহাদ?
জেহাদ এখন মুর্শিদাবাদের মাদ্রাসায় পড়াশোনা করে। এখন জেহাদ ও তার পরিবার ইন্ডিয়ান। সরকারি আবাস যোজনার ঘর মিলেছে। জমিও কিনেছেন দেড় কাঠা। সেখানেই চাষ আবাদ। কিন্তু কতটা স্বপ্ন পূরণ হল? জেহাদের বাবা বলেন, জমির কাগজ তো মেলেনি। আর আমার ছেলে এখন আর জেহাদ হোসেন ওবামা নয়। সে এখন জেহাদ হোসেন আলি। মাদ্রাসায় পড়ে। তবে ২০১০ সালের ঘটনা কোনওদিন ভুলব না। ঘরের উঠোনে চেয়ারে বসেছিলেন জেহাদের মা। তিনি বলেন,’ সেদিন যখন সরকারি হাসপাতালে গিয়েছিলাম, ওরা ২-৩ ঘণ্টা ফেলে রাখল। বলল তোমরা বাংলাদেশি। চলে যাও এখন থেকে। তবুও বলেছিলাম, আমি ছিটমহলবাসী। আমি বাংলাদেশি নই। ভারতের সঙ্গেই আমাদের যোগাযোগ। এখানেই বাচ্চা হবে আমার। রাত দশটায় বাচ্চা হল। নাম রাখা হল জেহাদ হোসেন ওবামা। সত্যি পরিচয় দিয়ে জিতেছিলাম সেদিন। আমরা ইন্ডিয়ান। আমরা আর ছিটবাসীও নই, বাংলাদেশিও নই। ‘
আসলে গোটা দেশ জুড়ে আজ নাগরিকত্ব নিয়ে এত টানাপোড়েন। তার মাঝেই উঠে আসছে এই জেহাদদের কথা। শান্তিপূর্ণ লড়াই করে নাগরিকত্ব পাওয়ার কথা। পরিচয়হীন মানুষ থেকে পরিচয় পাওয়ার কথা।
Leave a comment
Leave a comment
