সকালটা ছিল আলোর রঙে ভরা। পাড়ায় ঢাক বাজছে, ছেলেমেয়েরা হাসিমুখে ফুলের থালা হাতে একে অপরের কবজিতে রাখির সুতো বাঁধছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ছে রঙিন ছবি, হ্যাশট্যাগে ভাসছে #HappyRakshaBandhan। কিন্তু এই সাজানো ছবির আড়ালে আজকের দিনটার মাটিতে লেগে আছে শুকিয়ে যাওয়া রক্তের গন্ধ। বছর ঘোরার আগেই, কসবার ল কলেজে এক ছাত্রীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল হিংস্র লালসা, যেন প্রমাণ করতে, রবীন্দ্রনাথের সেই রাখীবন্ধনের মানবিক অর্থ আজ ধুলোয় মিশে গেছে। যেখানে কবিগুরু চেয়েছিলেন ভ্রাতৃত্বের সুতো হোক সাম্প্রদায়িক বিভাজন ভাঙার প্রতীক, সেখানে আজ রাখির গিঁট অনেকের কাছে হয়ে গেছে শরীরের উপর অধিকার ঘোষণা করার ছল।
অভয়া কাণ্ডের এক বছর। এই দিনেই এক তরুণীকে ছিঁড়ে নেওয়া হয়েছিল সভ্যতার বুক থেকে। সেই ঘটনার পর শপথ নেওয়া হয়েছিল, নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে, অপরাধীরা শাস্তি পাবে। কিন্তু কী বদলালো? বদলালো শুধু আমাদের উৎসবের ছবি, আমাদের ক্যাপশনের ভাষা। বদলালো না লালসার দাঁত, বদলালো না পুরুষতান্ত্রিক হিংসার মাংসাশী ক্ষুধা।
আজ ভাইয়ের হাতে রাখি বাঁধা হচ্ছে, কিন্তু সেই ভাই-ই ইনবক্সে পাঠাচ্ছে দেহখেকো বার্তা, অফিস থেকে বেরিয়ে বাসে চেপে তাকাচ্ছে অপরিচিত নারীর বুকে। এই উৎসবে প্রতিশ্রুতির ভাষা আছে, কিন্তু নেই দায়িত্বের অর্থ। বোন মানে কেবল নিজের বোন, পাশের বাড়ির মেয়েটি, ক্লাসের সহপাঠিনী, বা রাস্তায় হেঁটে যাওয়া নারী, তাদের জন্য রাখির সুতো বাঁধা হয় না।
অভয়ার নামে আজ মোমবাতি জ্বলছে, কসবার ছাত্রীর নাম হয়তো কাল ভুলে যাবে শহর। কিন্তু তাদের রক্তের দাগ আমাদের সমাজের কপালে স্থায়ী। সেই দাগ মুছতে হলে কব্জিতে নয়, মগজে বাঁধতে হবে রাখির গিঁট। রবীন্দ্রনাথের রাখীবন্ধন ছিল ভয় ভাঙার, নিরাপত্তা দেওয়ার, ভ্রাতৃত্বের প্রতীক, আজ সেটা যেন দাঁড়িয়ে আছে বিজ্ঞাপনের বিলবোর্ডে, আর বাস্তবে মেয়েরা দাঁড়িয়ে আছে আতঙ্কের অন্ধকারে।
তবু হয়তো কোনও একদিন, এই সুতোর গিঁট সত্যিই বদলে দেবে ইতিহাসের রঙ, যেদিন রাখির সুতো হবে ঢাল, আর প্রতিশ্রুতির শপথ ভেঙে পড়বে না লালসার দাঁতের আঘাতে। যেদিন কব্জিতে বাঁধা রঙিন সুতোয় মেয়েরা চিনবে না ভণ্ডামির গন্ধ, বরং চিনবে নিরাপত্তার নিঃশ্বাস, সেই দিনেই রাখিবন্ধন ফের পাবে রবীন্দ্রনাথের লেখা, আর হারানো অর্থ ফিরে আসবে আমাদের বিবেকে।
