দিব্যেন্দু ঘোষ
পোস্টকার্ডের হলুদ রং আজ বড্ড ফ্যাকাশে, গন্ধ বড় উচাটনী, সেই ইনল্যান্ড খাম আজ বিবর্ণ, পাংশুটে শরীরে এলেবেলে পড়ে থাকে, লাল ডাকবাক্সের তালায় মরচে ধরা, ছোট্ট ছেলেটা ভেলভেলেটা খেলতে খেলতে মজা করে দু-এক টুকরো ঢিল ঢুকিয়ে দেয় কালো শেড দেওয়া ফোকর দিয়ে।
মায়া, সাথে শরতের শ্বেত মেঘের মতো এলোমেলো ছোঁয়া, প্রেমে পড়া পৃথিবীতে কাশফুলের মাথা দোলানো, উত্সব আসে ঘটা করে, আরও দূরে সরে যায় প্রতিটা চিঠি, প্রথম প্রেমের মতো, চেনা হয়ে ওঠে না ঠিক। প্রতিটি শব্দে কামনা লেগে থাকে, প্রতিটি অক্ষরে থাকে প্রথম চুম্বনের আবেগ। প্রতিটা ধ্বনি যেন চিৎকার করে বলতে চায়, আমি তোমাকে ভালবাসি… চিঠির এই এক মায়া। চিঠির বাক্স ভরে যায়, ভরতে থাকে, একটা চিঠিও পড়ে ওঠা হয় না। অথচ প্রযুক্তির দোহাইয়ে প্রেম, দ্রোহ, কবিতা, গল্পগুলো আর চিঠি হয়ে উঠে না। অথচ চিঠির কালো অক্ষরগুলোয় কী মায়া, মমতা, মোহ, জাদু লেপ্টে থাকে!
কোনওদিন চিঠি লেখেননি এমন মানুষ হয়ত খুঁজে পাওয়া মুশকিল। কেউ লিখেছেন পরীক্ষার খাতায় আবার কেউ-বা লিখেছেন প্রিয় মানুষকে। যদিও আজকের দিনে দাঁড়িয়ে চিঠি যেন কেবল এক হারিয়ে যাওয়া শব্দ, ইতিহাসের ধুলোমাখা অধ্যায়, এক ভুলে যাওয়া রীতির নাম। অথচ একসময় চিঠি ছিল জীবনভর সংরক্ষণ করার মতো ধন। সাদা কাগজের পাতায় কালি-লেখা অক্ষরই ছিল প্রেম-ভালবাসার প্রকাশ, বিরহের বেদনা কিংবা পরিবারের খবরের একমাত্র বাহন। ডাকপিয়নের সাইকেলের ঘণ্টি শুনলেই অজান্তে বুক ধড়ফড় করত, চোখ ছুটে যেত দরজার দিকে। হয়ত একটা কাগজের টুকরো এসে বদলে দিত কারও পুরো দিনের মনখারাপ। শেষ কবে চিঠি লিখেছেন বা পেয়েছেন? এ প্রশ্নের উত্তর হয়ত অনেকেই এখন আর দিতে পারবে না। প্রযুক্তির কল্যাণেই চিঠি লেখার শিল্প প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এক অদৃশ্য আবেগের বাহন ছিল চিঠি। চিঠির কাগজে লেগে থাকত প্রিয়জনের হাতের স্পর্শ, অক্ষরে যেন মিশে থাকত তার হৃদয়ের কাঁপন। প্রেমিকার রাগভরা এক লাইন পড়ে মনে হত যেন সে সামনেই বসে আছে। দূরদেশে থাকা সন্তানের লেখা আক্ষেপভরা চিঠি মায়ের বুকের ভেতর হাহাকার তুলত। আজকের প্রজন্ম কল্পনাই করতে পারে না, একেকটা চিঠির জন্য মানুষ কীভাবে দিন গুনত। প্রবাসী স্বামীর চিঠি আসবে ভেবে স্ত্রী সারাদিন চৌকাঠে বসে থাকত। ছেলের খবর জানার জন্য বুড়ো বাবা ডাকপিয়নের পায়ের শব্দে দরজা খুলে দাঁড়াত।
সময় বদলেছে। আবেগও বদলে গেছে। আজ সবকিছু হাতের মুঠোয়, মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে, ইন্টারনেটের গতিতে। কথা বলতে আর দিন-রাত অপেক্ষা করতে হয় না, মুহূর্তেই ভিডিয়ো কলে মুখ দেখা যায়। কিন্তু এই তাৎক্ষণিক যোগাযোগে হারিয়ে গেছে অপেক্ষার সৌন্দর্য, হারিয়ে গেছে আবেগের গভীরতা। চিঠির সেই দমবন্ধ করা অপেক্ষা, পড়তে পড়তে কল্পনায় ডুবে যাওয়া এসব আর এখন নেই। এখন কাউকে না দেখেই তার লেখা পড়ে মুহূর্তে সেই মানুষকে চোখের সামনে কল্পনা করার আনন্দ নেই। প্রিয় মানুষের হাতে লেখা অক্ষরে যে কাঁপন থাকত, যে আবেগ ভেসে উঠত, মোবাইলের কি-বোর্ডে তা ধরা পড়ে না। মেসেঞ্জারের ইনবক্সে ভালবাসার বার্তা হয়ত হাজার হাজার; কিন্তু তার কোনওটিই হৃদয় ছুঁয়ে যায় না, যেমনটা ছুঁয়ে যেত একটি চিঠি। এসব এখন অনেকের কাছে কেবলই রূপকথা।
চিঠি ছিল আসলে এক টুকরো ইতিহাস। ভালবাসা, বিরহ, অভিমান, আক্ষেপ সবকিছুর সাক্ষী হয়ে সেই কাগজগুলো থেকে গেছে অনেকের পুরনো ঘরে, ট্রাঙ্কের কোণে কিংবা বইয়ের ভাঁজে। প্রযুক্তি হয়ত আমাদের জীবন সহজ করেছে; কিন্তু কাগজে লেখা সেই হাতের ছোঁয়া, সেই অপেক্ষার আবেগ আর সেই কল্পনার ডুব এসব কেড়ে নিয়েছে।
১ সেপ্টেম্বর ‘আন্তর্জাতিক চিঠি দিবস’। এই দিবসের শুরু ২০১৪ সালে অস্ট্রেলিয়ান রিচার্ড সিম্পকিনের হাত ধরে। নব্বই দশকের শেষের দিকে তিনি দেশের নামী ব্যক্তিত্বদের চিঠি পাঠাতেন। তবে বেশিরভাগ সময় তিনি সেসব চিঠির উত্তর পেতেন না। আর যখন কোনও চিঠির উত্তর পেতেন, তখন তার আনন্দের সীমা থাকত না। সেই ভালবাসা থেকে সিম্পকিন ২০১৪ সালে এই দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেন। কারণ, তিনি চেয়েছিলেন চিঠি লেখার চর্চা আবার ফিরে আসুক। তারপরেও কি চিঠি আসে? ভাঁজ খুলে কেউ কি পড়ে হৃদয়ের গোপন কথা? কারও মনে অনুকম্পা কি জমাট বাঁধে? তবুও যে চিঠি আসে না…
তোমার নগরে ডাক পিয়নের অভাবে
আমিও পথ হারিয়েছি
তোমাকে ছোঁয়াতে।
কতবার তোমার শহরে…
তোমার নাকি অফুরন্ত ব্যস্ততা
রোজ আমার নগরের পথে
কত কত ডাক পিয়ন আসে যায়
রোজ রোজ চলাচলে।
অথচ, আমার কোনও চিঠি নেই;
আমার নামে তুমিও উড়োখামে;
একটিও চিঠি আসে না আজও।
অথচ তোমার জন্য
উজাড় আমার
রোদেলা পৃথিবী।
আমায় নীল খামে তুমিও অর্ধেক নিজের করে
উজাড় করেছি আমি আমার ঠিকানার সবটুকু;
তুমি আজও অফুরন্ত ব্যস্ততায় দিশেহারা
জানো না এখনও
কীভাবে উড়োখামে মেঘেরা হাওয়ায় ভাসে।
হয়ত হাজার হাজার বছর পরে
মাঘের নীল আকাশে বাতাসে ভেসে
সমুদ্রের দিকে যখন উড়ে যাব
ঠিক হয়ত একদিন প্রাপকের ঠিকানায়
ভেসে আসবে ইথারে ছোট্ট বার্তায় চিঠি
মনে রেখো তোমার আঁচলে বেনামি খামে।
হাজার হাজার বছর আগে এমন উড়ো দিনে
ঠিকানারা ডাক পিয়নের ডাকে তোমাকে ছোঁয়াতে।
ভিতরের নরম শ্বাসকে আর আমি নতুন ভোরে
বিশ্বাসের স্রোতে পেয়েছি আমাকে
অস্তিত্বের বিকারে আমিও
আজও তাই অটুট আমার বিশ্বাসে…
যন্ত্রের প্রেমে ঠিকানার কলি
পাতা ছেঁড়া চিঠিগুলোতে আমি এখনও
স্পর্শ খুঁজি, গন্ধ শুঁকি
কত রাত জেগে এ চিঠির কালিতে
উজাড় করেছি চোখের প্রিয়মাণ স্বপ্নরাশি।
ঠক ঠক ঠক…কে? চিঠি। কার চিঠি এল? এই যে কৌতূহল, আকুলতা, এই অনুভূতির কোনও ভাষা নেই। শুধু চিঠিতে থাকা শব্দের ঘ্রাণ নিয়েই কত মানুষ কত রাত নির্জনে কাটিয়েছে, কত চোখ শুধু শব্দের পর শব্দের গাঁথুনির দিকে তাকিয়ে অশ্রু-সাগর বইয়ে দিয়েছে, তা চিঠির গভীরতা বোঝায়। চিঠি পাওয়ার ব্যাকুলতা এবং প্রিয় মানুষের হাতে লেখা অক্ষরের মধ্যে যে আবেগ, মায়া, ভালবাসা থাকে, তা অন্য কোনও মাধ্যমে পাওয়া যায় না। মূলত, চিঠি লেখার ঐতিহ্য একসময় ব্যক্তিগত, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। একটি হাতের লেখা চিঠি ছিল ব্যক্তিগত স্পর্শের প্রতীক, যা আজকের ডিজিটাল বার্তায় পাওয়া যায় না। চিঠি লিখতে গেলে চিন্তাগুলোকে সুন্দরভাবে সাজাতে হত। ধীরে ধীরে সেই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মানুষের অভিজ্ঞতা এবং চিন্তাভাবনার গভীরতা ফুটে উঠত। এছাড়া প্রাচীন চিঠিগুলো শুধু ব্যক্তিগত নয় বরং ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক দিক থেকেও মূল্যবান ছিল। প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ চিঠি আদান-প্রদান করেছে, ইলিয়াডে তার উল্লেখ আছে। হিরোডোটাস এবং থুসিডাইডিসের রচনাবলিতেও উল্লেখ করা হয়েছে।
‘ফ্রম হেল লেটার’ (জাহান্নাম থেকে চিঠি) এমনই এক চিঠি, যেটি ১৮৮৮ সালের অক্টোবরে হোয়াইটচ্যাপেল ভিজিল্যান্স কমিটির চেয়ারম্যান জর্জ লুস্ককে একটি সংরক্ষিত অর্ধেক মানব কিডনির মধ্যে পাঠানো হয়েছিল। চিঠিতে লেখা আছে, জাহান্নাম থেকে জনাব লুস্ক, স্যর আমি একজন মহিলার কেটে নেওয়া কিডনির অর্ধেক অংশ আপনার জন্য পাঠিয়েছি, এর অন্য টুকরোটি আমি ভাজা করে খেয়েছি, এটি খুব দারুণ ছিল। আমি আপনাকে রক্তাক্ত ছুরিটি পাঠাতে পারি, যা এটি বের করে নিয়েছিল, যদি আপনি আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেন। ইতি, মিস্টার লুস্ক। যখন পারো তখন আমাকে ধরে নিয়ো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘ছিন্নপত্র’র চিঠির কথা উল্লেখ করতে গিয়ে বলেছেন, ‘পৃথিবীতে অনেক মহামূল্য উপহার আছে, তার মধ্যে সামান্য চিঠিখানি কম জিনিস নয়। চিঠির দ্বারা পৃথিবীতে একটা নতুন আনন্দের সৃষ্টি হয়েছে। আমরা মানুষকে দেখে যতটা লাভ করি, তার সঙ্গে কথাবার্তা কয়ে যতটা লাভ করি, চিঠিপত্র দ্বারা তার চেয়ে আরো একটা বেশি কিছু পেয়ে থাকি। আমার মনে হয়, যারা চিরকাল অবিচ্ছেদে চব্বিশ ঘণ্টা কাছাকাছি আছে, যাদের মধ্যে চিঠি লেখালেখির অবসর ঘটেনি, তারা পরস্পরকে অসম্পূর্ণ করেই জানে।’ চিঠি এমনই এক আশ্চর্য জিনিস।
এমনই আরেক চিঠির গুচ্ছ ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর তার কিশোরী কন্যা ইন্দিরা গান্ধীকে লেখা, যা পরবর্তী সময়ে ‘লেটারস ফ্রম আ ফাদার টু হিজ ডটার’ বলে পরিচিতি পেয়েছে। নেহরু ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশ নিয়ে তখন এলাহাবাদ জেলে বন্দি। সে চিঠি নীরস তথ্যে ভরা নয় বরং যেন সামনে বসে বাবা তার মেয়েকে পড়াচ্ছেন। যেমন, ‘‘Perhaps you remember a gentleman who came to see us in Geneva. His name is Sir Jagadish Bose. He has shown by experiments that plants have a great deal of life…” এইভাবে তিনি সহজ ভঙ্গিতে তার মেয়েকে বোঝান।
প্রেমপত্রের নজির সাহিত্যের ইতিহাসে কম নয়, সে কিটসের লেখা ফ্যানি ব্রাউনকেই হোক বা রিলকের লেখা লুই অ্যাদ্রিয়াস সালোমেকে। কিন্তু সমস্ত পত্রগুচ্ছর মধ্যেও যা সবচেয়ে দাগ কাটে তা হল কাফকার লেখা মিলেনাকে চিঠি। ২৩ বছরের মিলেনাকে কাফকা চিঠি লিখতে শুরু করেন এবং দ্রুতই চিঠি বদলে যায় প্রেমপত্রে। তাদের প্রেম টেকেনি, কিন্তু চিঠিগুলো রয়ে গেছে। মলয় রায়চৌধুরীকে লেখা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের চিঠি— আমার কথা হল যে যে বন্ধু আছ, কাছে এসো, যে ভালো কবিতা লেখো কাছে এসো, যে যে বন্ধু নও, বাজে কবিতা লেখো, দূর হয়ে যাও কাছ থেকে। বয়সের ব্যবধান তোলা আমার কাছে অত্যন্ত ভালগার লাগে।
এই ডিজিটাল যোগাযোগের যুগে চিঠির সেই আবেদন এখনও কি রয়ে গেছে? যেখানে মুহূর্তে প্রিয়জনের সঙ্গে কথা বলা যায়। হয়ত রয়েই গেছে। হয়ত কেউ কোথাও, আমার মতো পাগলাটে কেউ, উসকোখুসকো চুলে আঙুল চালাতে চালাতে বিশ্ব চিঠি দিবসে আবার কালি, কলম ও কাগজ নিয়ে বসি, কেউ হয়ত লিখবে, বা পারবে না কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মতো বলতে বা লিখতে, ‘হেমন্তের অরণ্যে আমি পোস্টম্যান দেখেছি অনেক’। না পারুক, চেষ্টা অন্তত করবে একটা আর্জি নিয়ে, চিঠিরা বাঁচুক, শব্দেরা বাঁচুক। কালি-কলম-মন, এই তিনের মিলন হোক আবার, একটা বিপ্লব হোক, চিঠির বিপ্লব।