সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিষিদ্ধ করার বিরুদ্ধে শুরু হওয়া আন্দোলন থেকে মুহূর্তেই দুর্নীতিবিরোধী অভ্যুত্থান। এরপর রাতারাতি জনরোষের মুখে নেপালে সরকারের পতন। গত কয়েক বছরে শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, বাংলাদেশ থেকে আজকের নেপাল, সর্বত্র প্রায় একই দৃশ্যপট দেখা যাচ্ছে কেন?
তথ্য বলছে, গত তিন বছরে ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোতে অভূতপূর্ব রাজনৈতিক পট পরিবর্তন ঘটেছে। শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক ধস ও রাজাপক্ষের পতন, পাকিস্তানে ইমরান খানের ক্ষমতাচ্যুতি, বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তন, প্রতিটি ক্ষেত্রেই জনআন্দোলন সরকার পতনের পথ তৈরি করেছে। এবার সেই তালিকায় যুক্ত হল নেপাল।
নেপালে যে কারণের জন্য বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল সরকার সেই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করার পরও প্রতিবাদীরা শান্ত হয়নি। রাজধানীতে স্লোগান উঠেছে “কেপি চোর, দেশ ছোড়।” উত্তাল প্রতিবাদে বাংলাদেশের শেখ হাসিনাকে ভারতে আর শ্রীলঙ্কার গোটাবায়া রাজাপক্ষকে মালদ্বীপে আশ্রয় নিতে হয়। সূত্র বলছে, ওলি দুবাই পালিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
এশিয়ায় ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোতে বারবার প্রায় একই ধরনের ঘটনা কেন ঘটছে তা ভাবাচ্ছে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের। নেপালের ঘটনার পিছনে সেদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও তার পেছনে বাইরের কোনও শক্তির হাত আছে বলে মনে করছেন। যেমন নেপালের বর্তমান অর্থনীতিতে চিন ও আমেরিকার বড় প্রভাব কাজ করছে। ২০২৪ সালের জুলাইয়ে চতুর্থবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে ভারতের সঙ্গে দূরত্ব বাড়িয়ে ওলি ক্রমশ চিনের দিকে ঝুঁকেছেন। ক্ষমতায় এসেই নয়াদিল্লি নয়, প্রথম বিদেশ সফর করেছেন বেজিংয়ে। চিনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (BRI)-এ সই করে তিনি ৪১ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের সহায়তা পেয়েছেন।
অন্যদিকে ট্রাম্প প্রশাসন এ বছর পুনরুজ্জীবিত করেছে “মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ নেপাল কমপ্যাক্ট” প্রকল্প, যেখানে জ্বালানি ও সড়ক উন্নয়নের জন্য ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের সাহায্য দেওয়া হবে। যদিও একইসঙ্গে চিনের উপস্থিতি আমেরিকার জন্য অস্বস্তিকর। ওলির চিনের বিজয় দিবস প্যারেডে অংশগ্রহণকেও আমেরিকা-বিরোধী বার্তা হিসেবে দেখা হয়েছে। ফলে নেপাল হয়ে উঠেছে আমেরিকার চিন-বিরোধী অবস্থানের নতুন কেন্দ্র। কোনও কোনও বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, নেপালের এই আন্দোলনও আমেরিকা-চিন ছায়াযুদ্ধের অংশ।
আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির বিশ্লেষক এস এল কান্তন বলেছেন, এটা ‘একশো ভাগ আমেরিকার পরিকল্পিত বিপ্লব’ যা বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের ধাঁচে সাজানো। তাঁর দাবি, “যুবকদের উস্কে দেওয়া, সংসদ ও নেতাদের বাড়িতে আগুন লাগানো, তারপর আমেরিকাপন্থী এক নেতাকে ক্ষমতায় বসানো, এটাই মার্কিন নকশা।”
নেপালে আসলে কী ঘটছে? ২০০৮ সালে প্রজাতন্ত্র ঘোষণার পর থেকেই ক্ষমতা দোলাচলে ঘুরছে তিন প্রভাবশালী নেতার মধ্যে— চিনপন্থী বলে পরিচিত ওলি, মাওবাদী কেন্দ্রের পুষ্পকমল দাহাল ‘প্রচণ্ড’ এবং কংগ্রেস প্রধান শের বাহাদুর দেউবা। তিনজনের বিরুদ্ধেই দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। অর্থনৈতিক স্থবিরতা ও বেকারত্ব তরুণদের ক্ষোভকে আরও উস্কে দিয়েছে। নেপালে বিক্ষোভ ক্রমশ তীব্র হচ্ছে। আশঙ্কা, খুব শিগগিরই এখানে হয়ত আমেরিকাপন্থী কোনও ‘রাজতন্ত্র’ পুনঃপ্রতিষ্ঠা হতে পারে, যেমন বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কায় ঘটেছে।