নেপালের অন্যতম ঐতিহ্যশালী হোটেলকে ঘিরে কালো ধোঁয়া। এই ছবি দেখে চমকে গিয়েছিল গোটা দুনিয়া। নেপালের ক্ষোভের আগুনে পুড়েছিল গোটা হোটেল। চলতি সপ্তাহের ঘটনা। সেদেশের সর্বোচ্চ হোটেল হিলটন কাঠমান্ডু হিংসাত্মক আন্দোলনের আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে। ভয়াবহ দৃশ্য। কাঁচের এই সুউচ্চ টাওয়ার আগুন আর ধোঁয়ায় ভরে যায়। মূলত সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ তরুণ প্রজন্মের আন্দোলনকারীরা পার্লামেন্ট ভবন, রাজনৈতিক নেতাদের বাসভবনসহ সরকারি প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি সম্পত্তিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। এই ঘটনায় এখনও পর্যন্ত প্রায় ২০ জনের প্রাণহানি ঘটেছে।
ধীরে ধীরে নেপালের বুকে মাথা তুলেছিল হিলটন হোটেল। শঙ্কর গ্রুপ ২০১৬ সালে এই প্রকল্প শুরু করে। লক্ষ্য ছিল নেপালের আতিথেয়তার খ্যাতিকে আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছে দেওয়া। কাজ চলাকালীন নানা বাধা আসে, বিশেষ করে কোভিড-১৯ মহামারির সময় কাজ দীর্ঘদিন বন্ধ থাকে। প্রায় ৭ বছর পর, প্রায় ৮ বিলিয়ন রুপি বিনিয়োগে, অবশেষে ২০২৪ সালের জুলাই মাসে হোটেলটির উদ্বোধন হয়।
কাঠমান্ডুর নক্সাল এলাকায় অবস্থিত ৬৪ মিটার উঁচু এই ভবনটি নেপালের সর্বোচ্চ হোটেল হয়ে ওঠে। এখানে মোট ১৭৬টি রুম ও স্যুইট ছিল। হিলটন শুধু বিলাসবহুল হোটেলই ছিল না, বরং এক ধরনের সাংস্কৃতিক প্রতীক। এর ঝকঝকে কাঁচের দেওয়ালে ছিল উল্লম্ব ফিন, যা বৌদ্ধ প্রার্থনার পতাকার প্রতীকী রূপ। দিনে সূর্যের আলোয় আর রাতে রঙিন আলোর ঝলকে ভবনটির রূপ বদলে যেত।
ভবনের এক পাশ কাঠমান্ডুর ব্যস্ত নগরজীবনের সঙ্গে মিশে থাকলেও অপর পাশ থেকে দেখা যেত লাংটাং পর্বতমালা। ফলে অতিথিরা প্রকৃতি ও শহর, দুটো অনুভবই একসঙ্গে উপভোগ করতে পারতেন।
বাইরে প্রবাহিত রেখার মতো ডিজাইন আর ভেতরে বিশ্বমানের আতিথেয়তা সব মিলিয়ে হোটেলটি ছিল এক অনন্য স্থাপত্য। নিচের তলায় ছিল লবি, ব্যাংকোয়েট হল ও মিটিং স্পেস। উপরের দিকে অতিথিদের রুম, যেখান থেকে খোলা চোখে দেখা যেত পাহাড় আর উপত্যকা।
এছাড়া ৫টি রেস্টুরেন্ট, স্পা, জিম, ইভেন্ট ফ্যাসিলিটি, ইনফিনিটি পুল সবই ছিল এখানে। সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল রুফটপ বার “ওরিয়ন”। সেখানে কাঠের কারুকাজ ও শিল্পকলা নেপালের ঐতিহ্য ফুটিয়ে তুলত। এখান থেকে দেখা যেত হিমালয়ের রাতের আকাশ।
নেপাল ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল হওয়ায় হোটেলটি শিয়ার ওয়াল ও ড্যাম্পিং সিস্টেম দিয়ে তৈরি হয়েছিল, যাতে ভূমিকম্প হলেও “immediate occupancy building” হিসেবে নিরাপদ থাকে।
আজ সেই স্বপ্ন ছাই হয়ে গেছে। রঙিন কাঁচের ভবনটি এখন আগুনে পুড়ে কালো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জানালা ভেঙে পড়েছে, ভেতরের সবকিছু পুড়ে ছাই। হিলটনের ধ্বংস কেবল একটি হোটেলের ক্ষতি নয়, এটি দেখিয়ে দিল দেশ রাজনৈতিক অস্থিরতায় ভুগলে কতটা ভঙ্গুর হয়ে যায় উন্নয়নের স্বপ্ন। বছরের পর বছর বিনিয়োগে গড়ে ওঠা পরিকল্পনা ও সংস্কৃতির প্রতীক, তা কয়েক ঘণ্টার ক্ষোভে ধ্বংস হয়ে গেল।
উল্লেখ্য, আন্দোলনটি শুরু হয়েছিল সোশ্যাল মিডিয়ায় বিধিনিষেধের প্রতিবাদ থেকে। পরে তা রূপ নেয় দুর্নীতি ও রাজনৈতিক স্থবিরতার বিরুদ্ধে বৃহত্তর বিদ্রোহে। এমনকি প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলির পদত্যাগও ক্ষুব্ধ তরুণদের শান্ত করতে পারেনি। এরই মধ্যে কাঠমান্ডুর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সাময়িকভাবে বন্ধ করতে হয়েছে, যা নেপালের পর্যটন নির্ভর অর্থনীতির জন্য বড় ধাক্কা।
