শুভ জন্মদিন মোদিজি
জাগতে রহো ‘চৌকিদার’
দিব্যেন্দু ঘোষ
সালটা ২০১২। ততদিনে তিনবার গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সির আলো তাঁর উপরেই নিবদ্ধ থেকেছে। ততদিনে সেই ভয়ঙ্কর গুজরাত দাঙ্গা ঘটে গেছে, দাঙ্গার কলঙ্কের কালো ছিটে তাঁর সাদা ফতুয়ায় দাগ ফেলেছে। ততদিনে তাঁকে রাজধর্ম পালনের নির্দেশ দিয়ে দিয়েছেন অটল বিহারী বাজপেয়ী। ততদিনে মামলার পর মামলা, তাঁর গুজরাত শাসনের সময়কালে দুঃশাসনের নিয়তি মাথার ওপর দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর। ততদিনে এক সঙ্ঘ-প্রচারক বুঝে ফেলেছেন রাজনীতির ধাঁধা। সংগঠন মজবুত হলে কোনও গুজরাত দাঙ্গাই রাজ্যপাট ভেঙেচুরে খান খান যে করে দিতে পারে না, ততদিনে তিনি মর্মে উপলব্ধি করেছেন।
ততদিনে শুধু গুজরাত নয়, বিজেপির অন্দরমহলে জন্ম নিয়ে নিয়েছে এক প্রভূত ক্ষমতার আধার। ততদিনে ইঙ্গিত স্পষ্ট, দুনিয়াদারির অসীম ভার তাঁর কাঁধেই ন্যস্ত হতে চলেছে। এক নয়া ভারতের রূপকার হতে চলেছেন তিনিই। যাঁর জন্মদিনে রাত বারোটাতেই ফোন আসে মহাশক্তিধর ডোনাল্ড ট্রাম্পের। সেই তিনি যে চতুর্থবারের জন্য গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী হতে চলেছেন, ২০১২-র এক সকালে যখন আমাদের বিমান আমেদাবাদের মাটি ছুঁল, ঠিক তখনই অনুভব করতে পেরেছিলাম। আগামী দুটো সপ্তাহ গুজরাতে কাটিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ বুঝে এসেছিলাম, কেন সেই চাওয়ালা বাবার সন্তান বাকিদের থেকে আলাদা, ভদনগরের সেই গলি, তস্য গলি পেরিয়ে সেই একচালা বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে বুঝে এসেছিলাম, ওই বাড়িতে জন্ম নেওয়া ছোট্ট ছেলেটার জেদ কেন বাকিদের থেকে আলাদা, কেন তিনিই পারেন, সেই যে ভদনগরের শর্মিষ্ঠা নামের বড় জলাশয়ে দাপিয়ে বেড়ানো ছেলেটা, ছোট্ট দুটো কুমিরছানাকে নিয়ে খেলা করা সেই ছেলেটার পড়াশোনায় মতি না হলেও বাড়ি থেকে পালিয়ে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক দলে ভিড়ে গিয়ে একটু একটু করে রাজনীতির গলি থেকে রাজপথে উত্তরণের কারণটা বুঝে এসেছিলাম আপাদমস্তক।
আজ থেকে তেরো বছর আগে তাঁকে জানার জন্য চষে ফেলেছিলাম গুজরাতের মাটি। আমেদাবাদ থেকে ভদনগর, আনন্দ থেকে গান্ধীনগর টং টং করে ঘুরে বেড়িয়েছি, সেই কুখ্যাত চমনপুরা থেকে নারোদা পাটিয়া, গুলবার্গ সোসাইটির বুকে কান পেতেছি, শুনতে চেয়েছি কত শত মানুষের হাহাকার, বুঝতে চেয়েছি এক চাওয়ালার ছেলের জীবন, যাঁর বাবা দামোদরদাসের ভদনগর স্টেশনে চায়ের স্টল ছিল, যেখানে কতদিন বাবাকে সাহায্য করেছে ছোট্ট ছেলেটা। গুজরাতের পথে-প্রান্তরে, গলি-উপগলিতে, জলাশয়-জঙ্গলে, আকাশে-মাটিতে যে মানুষটার স্পর্শ পেরিয়ে যাবে অনন্ত পথ, শুধু গুজরাত নয়, যে মানুষটাকে বহন করতে হবে গোটা দেশের ভার, একদিন একশো চল্লিশ কোটির ভার, বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির ভার।
সেদিনই দেখেছিলাম সেই মানুষটাকে খুব কাছ থেকে, আমেদাবাদে বিজেপির হেডকোয়ার্টারের সামনে, সেই বিশাল মঞ্চে, সেই সাফল্যের শামিয়ানার নীচে এক দীপ্ত, বলিষ্ঠ পদক্ষেপে এগিয়ে আসা একটা মানুষের সেই কণ্ঠ শুনেছিলাম, ‘মেরে প্যায়ারে ভাই অউর বহেনো’, খুব কাছ থেকে, চতুর্থবারের জন্য গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর, তখনও দুবছর বাকি দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে। কিন্তু সেদিনই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল দেওয়াল লিখন, যদিও তখন জন্ম নেয়নি ‘মোদি ম্যাজিক’, ‘মোদি হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়’, ‘অব কি বার মোদি সরকার’-এর মতো শব্দবন্ধ, কিন্তু গোটা গুজরাত জেনে গিয়েছিল আগামীর পদক্ষেপ, শুনতে পেয়েছিল আগামীর পদচারণা।
বিকেলে নারোদা পাটিয়ার গলির চায়ের দোকানে চা খেতে খেতে পড়ে নিতে চাইছিলাম মানুষের মন, যে মন গুজরাত দাঙ্গায় অনেকটাই বিদীর্ণ হয়েছে, কিন্তু শান্ত, নিরিবিলি তল্লাট হট্টগোল করে ওঠেনি কখনও, গুজরাতের মুসলিম মহল্লায় আজানের সুর কান্না বয়ে আনেনি। বহু মানুষের চোখের দিকে তাকিয়েছিলাম, সে সব চোখ পেরিয়ে এসেছে সেই কালো অধ্যায়, সে সব চোখ পেরিয়ে এসেছে নারোদা পাটিয়ার নৃশংস হত্যাকাণ্ড, সে সব চোখে আর লেগে নেই গুলবার্গ সোসাইটির বীভত্স হত্যালীলা। গুজরাতের দৃষ্টি নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদির তেজে দীপ্ত, উত্ফুল্ল। এক নয়া ভারতের কাণ্ডারীর জন্ম হচ্ছে ধীরে। দেখছে গুজরাত, দেখছে ভারত, দেখছে বিশ্ব। বার্তা স্পষ্ট। আমি এসে গেছি, আমি আসছি, আমি এগোচ্ছি।
গুজরাতে দাঁড়িয়ে মুসলিম মহল্লার অন্দরে ঢুকে অনেককে জিজ্ঞেস করেছি গুজরাত দাঙ্গার কথা, স্বজন হারানোর যন্ত্রণার কথা। কেউ সে প্রসঙ্গে তোলেনি। কেউ সে প্রসঙ্গ তুলতে চায় না। সবাই তখন ছুটছে গান্ধীনগর। চতুর্থবারের জন্য গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী পদে মোদির শপথগ্রহণের অনুষ্ঠান দেখতে। ভিড় আছড়ে পড়ছে, গন্তব্য গান্ধীনগর। হুঙ্কার ছাড়ছেন গুজরাতের বাঘ। ঘুমিয়ে পড়ছে নারোদা পাটিয়া, গুলবার্গ সোসাইটি। তেরো বছর আগে আমি গুজরাতের মাটিতে দাঁড়িয়ে পিছিয়ে যাচ্ছিলাম আরও দশটা বছর।
সেই ২০০২-এর ২৭ ফেব্রুয়ারি। গোধরা শহরের কাছে বহু হিন্দু তীর্থযাত্রী ও শত শত যাত্রীসহ একটি ট্রেনে আগুন লাগল। পুড়ে মৃত্যু হল অন্তত ৬০ জনের। উগ্র মুসলিমরা অগ্নিসংযোগ করেছে, এরকম খবর ছড়ালে, গুজরাত জুড়ে দাঙ্গা শুরু হয়ে যায়। প্রায় ২০০০ মানুষের প্রাণ যায়। অসংখ্য মানুষ আহত। মোদি সরকার বড় শহরগুলিতে কারফু জারি করে দেখামাত্রই গুলি করার নির্দেশ দেয় এবং দাঙ্গা প্রতিরোধে সেনাবাহিনী ডাকা হয়। গোধরা অগ্নিকাণ্ডে মৃত করসেবকদের দেহ আমেদাবাদে নিয়ে যাওয়ার মোদির নির্দেশকে দাঙ্গায় উস্কানিমূলক পদক্ষেপ বলে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়। ২০০৮-এ সুপ্রিম কোর্ট রাজ্য সরকারকে গুজরাত দাঙ্গার নটি কেস সম্বন্ধে পুনরায় অনুসন্ধানের নির্দেশ দিলে সরকার নতুন করে তদন্তের জন্য একটি বিশেষ তদন্তকারী দল গঠন করে। গুলবার্গ সোসাইটি হত্যাকাণ্ডে মৃত কংগ্রেস সাংসদ এহসান জাফরির বিধবা স্ত্রী জাকিয়া জাফরি ২০০৯-এর এপ্রিলে সুপ্রিম কোর্টে নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে মামলা করেন। বিশেষ তদন্তকারী দলকে এই বিষয়ে তদন্তের নির্দেশ দেয় দেশের শীর্ষ আদালত। এই তদন্তকারী দল মোদিকে ২০১০ সালের মার্চে জিজ্ঞাসাবাদ করে মে মাসে তাদের এই মর্মে প্রতিবেদন জমা দেন যে তারা এই অভিযোগের সত্যতার কোনও প্রমাণ পাননি। ২০১২-র মার্চে তদন্তকারী দল এই অনুসন্ধান বন্ধ করার আর্জি জানালে জাকিয়া জাফরি এর প্রতিবাদে একটি মামলা দায়ের করেন। সেই মামলাও খারিজ হয়ে যায়। কারণ, মোদির বিরুদ্ধে কোনও রকম সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ২০১২ সালে মোদি মন্ত্রিসভার প্রাক্তন মন্ত্রী মায়া কোদনানিকে গুজরাত দাঙ্গার সময় নারোদা পাটিয়া হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। দাঙ্গার কারণে রাজ্যের ভেতর ও বাইরে থেকে মোদিকে মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে ইস্তফা দেওয়ার জন্য চাপ বাড়তে থাকে। কেন্দ্রে টিডিপি ও ডিএমকে-র মতো বিজেপির দুই বন্ধু দলও এই মত প্রকাশ করে। বিরোধীরা লোকসভা অচল রাখে। ২০০২-এ গোয়ায় বিজেপির জাতীয় কার্যনির্বাহী সভায় মোদি ইস্তফা দিতে চেয়েছিলেন। পার্টি তা গ্রহণ করেনি। ২০০২-এর ১৯ জুলাই মোদি মন্ত্রিসভা একটি জরুরিকালীন সভার সিদ্ধান্তে গুজরাতের রাজ্যপালের নিকট ইস্তফা পেশ করলে বিধানসভা ভেঙে যায়। পরের বিধানসভা নির্বাচনে মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি ১৮২টির মধ্যে ১২৭টি আসন দখল করে।
ডেভিড ক্রনেনবার্গের সায়েন্স ফিকশন চলচ্চিত্র ‘দ্য ফ্লাই’ অনেকেই দেখেননি। সে ছবিতে ড. সেথ ব্রান্ডল এক গোপন গবেষণায় লিপ্ত, যার বিষয় এক বস্তুকে, এমনকি এক প্রাণীকে অন্য বস্তু বা প্রাণীতে রূপান্তর। গবেষণার একপর্যায়ে বড় রকমের ভুল হওয়ায় ড. ব্রান্ডল নিজে মানুষ থেকে সরীসৃপে রূপান্তরিত হতে শুরু করেন। চোখের সামনে নিজেকে বদলাতে দেখে ড. বিন্ডল হিশ হিশ করে মন্তব্য করেন, ‘বি অ্যাফ্রেইড, বি ভেরি অ্যাফ্রেইড।’ অর্থাৎ ভয় পাও, ভীষণ রকম ভীত হও। না, গুজরাতের মানুষ ভীত নন, দেশের মানুষ ভীত নন। তাই তাঁরা মোদিজ্বরে ভোগেন, ভুগছেন সেই ২০১৪ থেকে। দেশজুড়ে মোদির পক্ষে যে জোয়ার, দেশের যে কোনও নির্বাচনী এলাকা থেকে তিনি প্রার্থী হতে পারেন। কিন্তু মোদি বাছলেন বেনারস, শিবের সবচেয়ে প্রিয় ধাম। নির্বাচিত হয়ে মোদি সেই বেনারস থেকেই স্লোগান তুললেন, ‘বন্দে মাতরম’। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর যে কর্মসূচি মোদি ঘোষণা করেন তার অন্যতম হল গঙ্গা নদীর শুদ্ধি অভিযান। ‘ভারতমাতার সেবার সেরা পথ হলে মা গঙ্গার শুদ্ধি’। নির্বাচিত হওয়ার পর তাঁর প্রথম বিদেশ সফর ছিল ভুটান, তারপর বিশ্বের একমাত্র হিন্দুরাষ্ট্র নেপাল। নেপালি হিন্দুরা মোদিকে তাদের ধর্মভাই হিসেবে রাজকীয় সম্মানে অভিষিক্ত করে। কাঠমান্ডুতে পৌঁছে মোদির প্রথম সরকারি কর্মসূচি ছিল সে দেশের প্রধান হিন্দুমন্দির পশুপতিনাথ মন্দিরে পুজো। হিন্দু পণ্ডিতেরা পঞ্জিকা খুঁজে ঠিক করে দিয়েছিলেন কবে, কখন সে মন্দির ভ্রমণ সবচেয়ে শুভ হবে। ভারতের ভেতরেই অনেকে বিশ্বাস করেন, মোদি এসবই করেছেন হিন্দুত্ববাদীদের খুশি করার জন্য। আরএসএসের এজেন্ডা, হিন্দুত্বের প্রচার। মোদি তারই প্রচারক। হিন্দুধর্মের প্রচার। অসুবিধে কোথায়? তা বলে মুসলিমরা ব্রাত্য নয়। ভারত শুধু হিন্দুদের, এমন কথা ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীরা দীর্ঘদিন থেকে বলে আসছেন। মোদি নিজে সরাসরি সে কথা বলেননি।
তাঁকে ঘিরে অবিশ্বাস ছিল, ছিল দাঙ্গার কলঙ্ক আর ঘৃণা৷ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, কৈশোরে যাঁর অনেকটা সময় কেটেছে রেলস্টেশনে বাবার সঙ্গে চা বিক্রি করে৷ তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী। ভারত এখন সুপারপাওয়ার। ভারতকে ঘাঁটাতে ভয় পায় খোদ আমেরিকা, চিন। রাশিয়া তো বন্ধুদেশ। নিজেকে এবং দেশকে সেই উচ্চতায় নিয়ে যেতে পেরেছেন তিনিই। সেই ভদনগরের চাওয়ালার ছেলে। তাঁর গতিশীল নেতৃত্বে গুজরাত পরিণত হয়েছে ভারতের অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তিতে৷ কৌশলী প্রচার মোদিকে দিয়েছে উন্নয়নের অগ্রদূতের ভাবমূর্তি, বিপুল জনসমর্থন৷ সাম্প্রদায়িক আদর্শের কারণে ভোটারদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের সমর্থন মোদি পাননি, পান না৷ কিন্তু নির্বাচনের আগে দিল্লিকেন্দ্রিক রাজনীতির পুরনো ছক ভেঙে পরিবর্তনকামী তারুণ্যের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে তিনি ছিনিয়ে আনেন বড় জয়৷ গুজরাতের এক ঘাঞ্চি পরিবারের সন্তান নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদির ক্যারিশমা সেখানেই।
জন্ম ১৯৫০ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর৷ ছয় ভাইবেনের মধ্যে তৃতীয় মোদি স্কুলজীবনে ছাত্র হিসাবে ছিলেন মাঝারি মানের৷ তবে সেই সময়ই বিতর্ক আর থিয়েটারে ছিল তাঁর প্রবল আগ্রহ, যার প্রভাব তাঁর রাজনৈতিক জীবনেও স্পষ্ট৷ কৈশোরে বাবাকে সাহায্য করতে রেল ক্যান্টিনে চা বিক্রি করেছেন। পরে কাজ করেছেন গুজরাত রোড ট্রান্সপোর্ট অথেরিটির ক্যান্টিনবয় হিসাবে৷ ঘাঞ্চি সম্প্রদায়ের রীতি অনুযায়ী, ১৭ বছর বয়সেই যশোদাবেন নামের এক বালিকার সঙ্গে বিয়ে হয় মোদির৷ সেই সংসার ছিল মাত্র তিন বছরের, শারীরিক সম্পর্কও তাঁদের ছিল না৷ একজন স্বেচ্ছাসেবী হিসাবে আট বছর বয়স থেকেই রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন মোদি৷ দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি পাওয়ার সময়ও তিনি প্রচারক হিসাবে আরএসএসের সঙ্গে ছিলেন৷ ১৯৭১ সালে যুদ্ধের পর আনুষ্ঠানিকভাবে আরএসএসে যুক্ত হন, উগ্র সাম্প্রদায়িক কর্মকাণ্ডের কারণে যে সংগঠনটি এ পর্যন্ত তিন দফা নিষিদ্ধ হয়েছে৷ ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭৫ সালে দেশে জরুরি অবস্থা জারি করে ধরপাকড় শুরু করলে আত্মগোপনে যান মোদি৷ এর দশ বছর পর আরএসএসের সিদ্ধান্তে ভারতীয় জনতা পর্টির হয়ে কাজ শুরু করেন তিনি৷ ১৯৯৫ সালের রাজ্যসভা নির্বাচনে মোদি ছিলেন বিজপির অন্যতম কৌশলপ্রণেতা, তখন তিনি দলের গুজরাত শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক৷ সেই সাফল্যের পর অন্যান্য নির্বাচনেও তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন এবং ১৯৯৮ সালে দলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান৷ ২০০১ সালে কেশুভাই প্যাটেলের স্বাস্থ্যের অবনতি হলে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে আবির্ভূত হন নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদি। আরও তিন দফা তিনি ওই পদে বিজয়ী হয়েছেন। গুজরাতকে পরিণত করেছেন উন্নয়নের মডেলে৷ ২০০৭ সালের পর তিনি নিজেকে তুলে ধরতে শুরু করেন একজন সর্বভারতীয় নেতা হিসাবে, প্রতিষ্ঠা করেন ‘ব্র্যান্ড মোদি’৷ আর এই চেষ্টায় তিনি যে পুরোপুরি সফল, তার প্রমাণ ২০১৪ সালের লোকসভা ভোট৷ দলের প্রার্থী মনোনীত হওয়ার পরপরই তিনি ভারতের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার অগ্রসর তরুণদের সঙ্গে বসেন এবং নির্বাচনী প্রচারের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেন৷ এর মধ্য দিয়ে মোদি কার্যত বিজেপির দিল্লিকেন্দ্রিক নেতৃত্ব কাঠামোকে প্রত্যাখ্যান করে ভারতীয় তারুণ্যের পরিবর্তনকামী মানসিকতাকেই কুর্নিশ করেন৷ হলোগ্রাম থেকে হোয়াটসঅ্যাপ, সর্বত্র চলে মোদির পক্ষে অভিনব প্রচার৷ ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌড়ে নরেন্দ্র মোদি পাড়ি দিয়েছেন তিন লাখ কিলোমিটার পথ৷ সারা ভারতে পাঁচ হাজার ৮২৭টি জনসভায় তিনি অংশ নিয়েছেন, নয় মাসে মুখোমুখি হয়েছেন পাঁচ কোটি মানুষের৷ হাজার হাজার কর্মী সমর্থক মোদির মুখোশ পরে এ সব জনসভায় হাজির হয়েছেন৷ সারা ভারতে এক হাজার স্টল থেকে ভোটারদের মাঝে বিলি করা হয়েছে ‘মোদি চা’৷ সেই নির্বাচনে বিজেপির প্রতিশ্রুতি ছিল, মোদি প্রধানমন্ত্রী হলে দেশের অর্থনীতি নতুন গতি পাবে, গুজরাতের আদলে তিনি পুরো ভারতকে বদলে দেবেন৷ ভারতকে কখনও মাথা নোয়াতে দেবেন না৷ অবশ্য উচ্চাকাঙ্ক্ষী মোদির সমালোচনাও ছিল অনেক৷ বলা হয়েছে, তিনি স্বৈরাচারী মেজাজে দল চালাতে চান, প্রাতিষ্ঠানিক রীতিনীতি মানেন না৷ মোদির শিক্ষা ও অর্থনীতির জ্ঞান নিয়েও ঠাট্টা-বিদ্রুপ হয়েছে বিরোধী শিবিরে৷ বলা হয়েছে, দাঙ্গার কলঙ্ক আড়াল করতেই মোদি উন্নয়নের ফাঁপা বুলি আওড়াচ্ছেন৷ তার পরেও নির্বাচনে অভাবনীয় জনসমর্থন পেয়েছে বিজেপি৷ ভরাডুবি হয়েছে গান্ধী পরিবারের প্রতাপ আর ভারতীয় কংগ্রেসের৷
অনেকেই বলছেন, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ তারিখে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ৭৫তম জন্মদিন পালনের সঙ্গে সঙ্গে তিনি তাঁর সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং বছরের মুখোমুখি হচ্ছেন। তবে সঙ্কটের সমাধান করে চলেছেন। বয়স খাতায়-কলমে আঁচড় কাটছে ঠিকই, কিন্তু এখনও কর্মক্ষমতায় অধিকাংশ তরুণকে পিছনে ফেলে রাখার ক্ষমতা ধরেন দেশের প্রধানমন্ত্রী। নিত্য নতুন সংস্কারের উদ্যোগে দেশকে এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যও তাঁর অবিচল। এই তো মাসখানেক আগের কথা। ১৫ অগাস্ট, ২০২৫ তারিখে স্বাধীনতা দিবসে দেশকে আর্থিক ভার থেকে স্বাধীন করার যে প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছিলেন, তা জিএসটি কাউন্সিলের বৈঠকে নির্ধারিত সিদ্ধান্তে পালন করা হয়েছে সর্বতোভাবেই। এবার ঠিক যেন জন্মদিনের রিটার্ন গিফটের পালা।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ তারিখে তাঁর জন্মদিনে ‘স্বস্থ নারী, সশক্ত পরিবার অভিযান’ শুরু করতে চলেছেন। নাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে, দেশব্যাপী এই অভিযানটি নারী ও শিশুদের জন্য স্বাস্থ্যসেবা উন্নত করার লক্ষ্যে তৈরি করা হয়েছে। স্বাস্থ্যসেবার উন্নত অ্যাক্সেস, উপযুক্ত যত্নআত্তি এবং সচেতনতা বৃদ্ধি করার মাধ্যমে তা পরিচালিত হবে। এখানেই কিন্তু তাঁর উদ্যোগ শেষ নয়। বারে বারে নিঃসন্দেহাতীতভাবে তিনি প্রমাণ করে দিয়েছেন যে সঙ্কটের কালে ঘুরে দাঁড়ানোর মন্ত্রও তাঁর চেয়ে ভাল আর কেউ জানেন না।
৫০ শতাংশ মার্কিন শুল্ক আরোপ থেকে শুরু করে প্রথমবারের মতো জোট রাজনীতি পরিচালনা পর্যন্ত, তাঁর সামনের পরীক্ষাগুলি নিম্নমানের নেতাদের ভেঙে দেবে। তবুও আরএসএস প্রচারক থেকে বিশ্ব রাজনীতিবিদ পর্যন্ত মোদির অসাধারণ যাত্রা একটি ধারাবাহিক প্যাটার্ন প্রকাশ করে, প্রতিটি সঙ্কট পুনর্নবীকরণের জন্য অনুঘটক হয়ে উঠেছে এবং প্রতিটি বিপর্যয় একটি দর্শনীয় প্রত্যাবর্তনের লঞ্চপ্যাড হয়ে উঠেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে শুল্ক যুদ্ধই যেমন এই মুহূর্তে মোদির সঙ্কট-সুযোগ-সুবিধা নীতির সবচেয়ে বড় উদাহরণ। চলতি বছরের অগাস্টে যখন মার্কিন রাষ্ট্রপতি ভারতীয় পণ্যের উপর ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছিলেন, তখন অনেকেই আশা করেছিলেন যে মোদি আত্মসমর্পণ করবেন। পরিবর্তে, তিনি কৌশলগত অবাধ্যতার একটি মাস্টারক্লাস প্রদান করেছিলেন। ওয়াশিংটনের চাপের কাছে নতি স্বীকার করার পরিবর্তে মোদি দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করেছিলেন, আমাদের উপর চাপ বাড়তে পারে, কিন্তু আমরা সব কিছু সহ্য করব। তাঁর বার্তাটি ছিল স্পষ্ট, ভারত কৃষক, ক্ষুদ্র শিল্প বা জাতীয় স্বার্থের সাথে আপস করবে না। এর পর যা ঘটেছিল তা ছিল সম্পূর্ণ মোদির রসায়ন। ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ব্রাজিলের রাষ্ট্রপতি লুলা বহুপাক্ষিকতা রক্ষার প্রতিশ্রুতি নিশ্চিত করার আহ্বান জানান। মোদি এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মস্কোতে ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে দেখা করেন। প্রধানমন্ত্রী সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেন। চিন সফর, শি জিনপিংয়ের সঙ্গে বৈঠক। সাত বছরের মধ্যে বেজিংয়ে তাঁর প্রথম সফর। বিশ্ব দেখেছিল যে মোদি ট্রাম্পের অর্থনৈতিক শাস্তিকে কূটনৈতিক সুযোগে রূপান্তরিত করেছেন, ভারতকে পশ্চিমা হুমকির বিরুদ্ধে প্রতিরোধী এক নতুন বিশ্ব ব্যবস্থার নেতা হিসেবে স্থান দিয়েছেন। এসসিও শীর্ষ সম্মেলনে মোদি শি জিনপিং এবং পুতিনের পাশাপাশি দাঁড়িয়েছিলেন। ছবিগুলি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অস্থির করে তুলেছিল। প্রাক্তন মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টন মোদির কৌশলের বিশালতা তুলে ধরেছিলেন, হোয়াইট হাউস মার্কিন-ভারত সম্পর্ককে কয়েক দশক পিছিয়ে দিয়েছে, মোদিকে রাশিয়া এবং চিনের আরও কাছাকাছি ঠেলে দিয়েছে। ট্রাম্পের শুল্ক অজান্তেই মোদিকে গ্লোবাল সাউথের অবিসংবাদিত কণ্ঠস্বর হিসেবে মুকুট দিয়েছে।
কোভিডের সময়েও মোদি সঙ্কট ব্যবস্থাপনার দক্ষতা প্রদর্শন করেন। সমালোচকরা তাৎক্ষণিক চ্যালেঞ্জগুলির উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করার সময়ে মোদি বিশ্বের বৃহত্তম টিকাদান কর্মসূচি চালু করেছিলেন, যা ভারতের ১.৪ বিলিয়ন জনসংখ্যার সবার জন্য প্রযোজ্য ছিল। তিনি বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য সঙ্কটকে আত্মনির্ভর ভারতের জন্য একটি সুযোগে রূপান্তরিত করেছিলেন। সমালোচকরা যে মহামারীটির ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন তা তার সরকারের ধ্বংসের পরিবর্তে তাঁর নেতৃত্বে ভারতের স্থিতিস্থাপকতা প্রদর্শন করেছিল।
২০২৪ সালের নির্বাচনের ফলাফল, যা বিজেপিকে ২৪০টি আসনে নামিয়ে এনেছিল এবং এক দশকের মধ্যে প্রথমবারের মতো জোট সরকার গঠন করতে বাধ্য করেছিল, প্রাথমিকভাবে মোদির রাজনৈতিক শোকবার্তা হিসেবে দেখা হয়েছিল। বিরোধী নেতারা আনন্দের সঙ্গে মধ্যবর্তী নির্বাচনের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। তবুও এক বছরের মধ্যে মোদি ভারতীয় গণতন্ত্রের সবচেয়ে আশ্চর্যজনক রাজনৈতিক পুনরুদ্ধারের একটি অভিযান পরিচালনা করেছিলেন। বিজেপি হরিয়ানা, মহারাষ্ট্র এবং দিল্লিতে জয়লাভ করে, ১৯৯৮ সালের পর জাতীয় রাজধানীতে প্রথম বিধানসভা জয়লাভ করে।
মোদির জোট রাজনীতির ব্যবস্থাপনা সন্দেহবাদীদের ধুয়ে-মুছে দিয়েছে, যারা প্রশ্ন তুলেছিল যে প্রভাবশালী নেতা ক্ষমতা ভাগাভাগির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারবেন কি না। ওয়াকফ সংশোধনী বিলের মতো বিতর্কিত আইন পাস হওয়ার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে যে জোটের সীমাবদ্ধতা তাঁর রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তিকে দুর্বল করেনি। সম্প্রতি, সিএএ-এর কাটঅফ তারিখ ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে, যা আবারও প্রমাণ করে যে বিজেপির আদর্শিক এজেন্ডা কতটা সঠিক পথে রয়েছে।
গ্লোবাল সাউথের চ্যাম্পিয়ন হিসেবে মোদির আবির্ভাব তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক অর্জন। এসসিও শীর্ষ সম্মেলনে তাঁর উপস্থিতি বহুমেরু বিশ্বব্যবস্থার দিকে ভারতের অগ্রযাত্রার ইঙ্গিত দেয়। ৭৫ বছর বয়সে এসে তিনি কেবল ভারতের প্রধানমন্ত্রী নন, বরং একটি বিকল্প বৈশ্বিক ব্যবস্থার স্থপতি যা আত্মসমর্পণের চেয়ে সার্বভৌমত্বকে অগ্রাধিকার দেয়।
মোদি যখন জীবনের ৭৫তম বছরে পা দিচ্ছেন, তখন তাঁর সমালোচকদের অবসর গ্রহণের ভবিষ্যদ্বাণীগুলি অসার বলে প্রমাণিত হচ্ছে। তাঁর আমলে ভারত বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা এবং বিশ্বব্যাপী তাঁর মর্যাদা অভূতপূর্ব উচ্চতায় পৌঁছানোর সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও মোদির রাজনৈতিক পরিধি হ্রাস পাওয়ার কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
যে মানুষটি গুজরাতের ক্ষয়ক্ষতিকে অবকাঠামো বিপ্লবে, নোট বাতিলকে ডিজিটাল রূপান্তরে এবং এখন ট্রাম্পের শুল্ককে কর ত্রাণে রূপান্তরিত করেছিলেন, তিনি ৭৫ বছর বয়সে পৌঁছলেন একজন বয়স্ক রাজনীতিবিদ হিসেবে নয়, বরং তাঁর জীবনের সেরা নেতা হিসেবে। যে বয়সে বেশিরভাগ নেতা উত্তরাধিকার এবং অবসর নিয়ে চিন্তা করেন, সেই বয়সে মোদি নতুন অধ্যায় লেখায় ব্যস্ত।
ভদনগরের যে ছেলেটি রেলওয়ে স্টেশনে চা বিক্রি করত, এখন নিজের শর্তে বিশ্ব নেতাদের চা পরিবেশন করে, এমন একটি যাত্রা যা মোদি যে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেন তার অদম্য চেতনাকে নিখুঁতভাবে মূর্ত করে তোলে।
