স্নিগ্ধা চৌধুরী
আকাশে শরতের সাদা তুলো মেঘ, বাতাসে কাশফুলের দোলা, আর মন্থর ভোরের আলোয় শঙ্খের ধ্বনি। বাঙালির কাছে এ সময় মানেই মাতৃআহ্বানের ক্ষণ। মহালয়ার সুর থেকে শুরু হয় মহামায়ার আগমনের প্রতীক্ষা। কিন্তু কেবল আরাধনা নয়, দেবীর আগমন ও গমনকে ঘিরে রয়েছে পৌরাণিক তাৎপর্য, যা যুগে যুগে মানুষকে দিয়েছে আশা ও সতর্কতার বার্তা। প্রাচীন শাস্ত্রে বলা আছে, সিংহবাহিনী দুর্গা ভক্তের কাছে আবির্ভূত হলেও আগমন ও গমন ঘটে অন্য বাহনে। কখনও গজ, কখনও ঘোটক, কখনও নৌকা, আবার কখনও দোলা। আর প্রতিটি বাহন বহন করে ভিন্ন তাৎপর্য। গজ মানে শান্তি, সমৃদ্ধি ও উর্বর পৃথিবী। ঘোটক মানে অস্থিরতা, অশান্তি ও ধ্বংস। নৌকা বয়ে আনে জলের ইঙ্গিত, কখনও বন্যার ভয়, আবার কখনও উর্বরতার আশ্বাস। দোলা মানে অনিশ্চয়তা, রোগব্যাধি ও মহামারির অশুভ ছায়া। তাই মা দুর্গার বাহন দেখেই মানুষ ভবিষ্যতের শুভাশুভ আন্দাজ করে এসেছে যুগে যুগে।
হাতির পিঠে আগমন অর্থ পৃথিবী শস্যশ্যামলা হবে, মানুষ পাবে শান্তি, কল্যাণ এবং ভরা ভাণ্ডার। প্রকৃতি হাসবে, মাঠ ভরে উঠবে ফসলের রঙে, এবং মানবজীবন হবে সমৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতার প্রতীক। গজে আগমন সবসময় শুভ, কারণ এটি দেবীর উৎকৃষ্ট বাহন বলে ধরা হয়।
শাস্ত্রে বলা হয়েছে, “দোলায়াং মকরং ভবেৎ”। অর্থাৎ পালকিতে বিদায় মানেই রোগব্যাধি, মহামারি এবং অনিশ্চয়তার সম্ভাবনা। দোলার দোদুল্যমানতা মানুষ ও সমাজকে সতর্ক করে, সুখের সঙ্গে দুঃখ, সমৃদ্ধির সঙ্গে পরীক্ষাও আসে। তাই দোলায় গমনকে সতর্কতার বার্তা হিসেবে দেখানো হয়, যেন মানুষ প্রস্তুত থাকে অশুভ প্রভাব মোকাবিলা করতে।
নৌকা এবং ঘোটকও বিশেষ ইঙ্গিত বহন করে। নৌকায় আগমন বা গমন মানে জলমগ্নতার সম্ভাবনা, যা কখনও বন্যা বা প্রবল বর্ষণ আনে, আবার কখনও সেই জলে ভূমি উর্বর হয়ে ওঠে “শস্যবুদ্ধিস্তথা জলম্”।
ঘোটকে আগমন বা গমন মানে সংঘাত, ধ্বংস বা অশান্তির সম্ভাবনা। “ছত্রভঙ্গ স্তুরঙ্গমে”। এই বাহনগুলো, যদিও এ বছর সরাসরি প্রযোজ্য নয়, শাস্ত্রই মানুষকে শেখায় যে বাহনের ইঙ্গিত জীবনের দিক পরিবর্তন করে।
পঞ্জিকা জানাচ্ছে, এ বছর মহামায়ার আগমন ঘটছে গজে। অর্থাৎ হাতির পিঠে চেপে মা প্রবেশ করবেন মর্ত্যে। হাতি শক্তি ও স্থিতির প্রতীক, তাই শাস্ত্র বলে, গজে আগমন মানেই পৃথিবী হবে শস্যশ্যামলা, ভরে উঠবে ভাণ্ডার, মানুষ পাবে শান্তি ও কল্যাণ। মনে হবে, প্রকৃতি নিজেই যেন হাসিমুখে সন্তানের জন্য খুলে দিয়েছে সমৃদ্ধির ভাণ্ডার। এই আগমনের বার্তা নিঃসন্দেহে শুভ, নিঃসন্দেহে আশ্বাসবাণী।
কিন্তু শুভর পাশাপাশি লুকিয়ে আছে এক গভীর সতর্কবার্তা। কারণ বিদায়ের সময় মা দুর্গা চেপে বসবেন দোলায়। পালকির দোলার মতোই দুলতে থাকবে মানুষের ভাগ্য। শাস্ত্রমতে দোলায় গমন মানেই রোগব্যাধির ছায়া, মহামারির আতঙ্ক, সমাজের উপর দুর্ভোগের ভয়াল ছাপ। যেন মহাশক্তি সন্তানের সঙ্গে থেকে আনন্দ বিলিয়ে দিলেও বিদায়ের সময় মনে করিয়ে দেন, জীবন কেবল সুখে ভরা নয়, দুঃখ ও অশান্তিও তার সঙ্গী।
এই দ্বৈত বার্তাই মহামায়ার আসল রূপ। তিনি যেমন করুণাময়ী, তেমনই ভয়ঙ্করী। তিনি যেমন শান্তি আনেন, তেমনই সতর্ক করেন। তাঁর আগমন যেন সন্তানের হাতে রাখে আশীর্বাদের শস্যভরা ভাণ্ডার, আর গমন যেন বলে যায়, সাবধান হও, সতর্ক থেকো, অশুভকে হারানোর শক্তি তোমাদের মধ্যেই জাগাতে হবে।
পুরাণ বলে, কোনও বছর যদি আগমন ও গমন একই বাহনে ঘটে, তবে তার ফল সর্বদাই অশুভ হয়। কিন্তু এ বছর সেই ভয় নেই। মহামায়ার পদার্পণ হবে গজে, বিদায় হবে দোলায়। তাই সমৃদ্ধি ও অশুভ দুই-ই মিশে আছে বছরের ভাগ্যে। যেন এক হাতে মা কল্যাণ করছেন, অন্য হাতে তুলে দিচ্ছেন জীবনের পরীক্ষা।
তবু ভক্তহৃদয়ের বিশ্বাস অটুট! মহামায়া দোলার অশুভ ছায়াকেও গজের শুভশক্তিতে রূপান্তর করবেন। তিনি আসছেন আশীর্বাদের ধারা নিয়ে, বিদায় নিলেও রেখে যাবেন শক্তির বীজ। মা সর্বদা সন্তানদের মঙ্গল কামনাতেই বিরাজমান থাকেন।
