সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়
ফের কলকাতা শহরে একুশের স্লোগান। ফিবছরের মত কলকাতার প্রাণকেন্দ্র ধর্মতলা চত্বর লাখো মানুষের ভিড়ে পালিত হবে শহীদ তর্পণ। আন্দোলন-সংগ্রামের প্রতীক এই একুশের মঞ্চে আগামী দিনের আন্দোলনের রূপরেখা তৈরি করে দেবেন তৃণমূলের সভানেত্রী। তিন দশক পেরিয়ে গেলেও আজও এই একুশের মঞ্চকেই নিজেদের রাজনৈতিক লক্ষ্যপূরণের বার্তা হিসেবেই ব্যবহার করতে চান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এবারের একুশের সমাবেশের তাৎপর্য কিছুটা আলাদা হলেও প্রেক্ষিত কিন্তু বদলায়নি।
একদিকে আদালতে নির্দেশে একুশের মিছিলে নিয়ন্ত্রণ অন্যদিকে কলকাতার প্রাণকেন্দ্রে এই মেগা রাজনৈতিক সমাবেশ করা নিয়ে শাসকদল হিসেবে দায়বদ্ধতার প্রশ্ন এবং একই সঙ্গে আগামী বছর থেকে একুশের সমাবেশের জন্য বিকল্প জায়গা খোঁজার জন্য আদালতের প্রস্তাব– সব মিলিয়ে এবারের একুশের উদযাপন কিছুটা হলেও অন্য মাত্রা এনে দিয়েছে। তবে ৯৩ সালে যোগ্য ভোটারের ভোটাধিকার প্রয়োগের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার লড়াইতে যে একুশের আন্দোলন শুরু হয়েছিল তিন দশক পরে সেই একুশের মঞ্চে ফের ভোটাধিকার রক্ষার গণতান্ত্রিক অধিকার বজায় রাখার জন্য আন্দোলনের ডাক দেবেন তৃণমূলনেত্রী।
জাজবাত বাংলায় আরও পড়ুন
সেবার ছিল সচিত্র ভোটার কার্ড এবং সচিত্র ভোটার তালিকা প্রকাশের দাবি, এবার SIR এর নামে ছাব্বিশের নির্বাচনে যোগ্য ভোটারদের নাম যাতে ভোটার তালিকা থেকে বাদ না যায় তার জন্য আন্দোলনের কর্মসূচি তৈরি করে দেবেন মমতা। বিজেপি শাসিত রাজ্যে বাংলাভাষীদের টার্গেট করে বাংলাদেশী হিসেবে চিহ্নিতকরণের শুধু প্রতিবাদ জানানোই নয় এই রাজনৈতিক কৌশলের জেরে তৃণমূলের ভোট ব্যাংকে যাতে কোনো রকম আঘাত না আসে সে কারণে বাংলা ভাষা ও বাঙালির অস্মিতাকে কাজে লাগিয়ে বাঙালির জনজাগরণের ডাকও দেবেন তৃণমূল নেত্রী। অর্থাৎ ১৯৯৪ থেকে ২০২৫, ভোটদানের এই গণতান্ত্রিক অধিকারকে লড়াইয়ের ময়দানে সামনে রেখে এক সময় ক্ষমতা দখলের স্বপ্ন দেখা এবং বর্তমানে ক্ষমতার ভরকেন্দ্রকে সামলে রাখা। এই দুই প্রেক্ষিতেই রাজনৈতিক পটভূমিকায় একুশের মঞ্চ তিন দশক ধরে স্বমহিমায়।
১৯৯৪ থেকে ২০২৫, ভোটদানের এই গণতান্ত্রিক অধিকারকে লড়াইয়ের ময়দানে সামনে রেখে এক সময় ক্ষমতা দখলের স্বপ্ন দেখা এবং বর্তমানে ক্ষমতার ভরকেন্দ্রকে সামলে রাখা। এই দুই প্রেক্ষিতেই রাজনৈতিক পটভূমিকায় একুশের মঞ্চ তিন দশক ধরে স্বমহিমায়।
১৯৯৩ সালের ২১ জুলাই। বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি অন্যতম দিন। এই দিনটি বর্তমানের মুখ্যমন্ত্রী তৎকালীন রাজ্য যুব কংগ্রেস সভানেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জননেত্রী হয়ে ওঠার অন্যতম মাইলস্টোন। কি হয়েছিল সেদিন— “একটি সচিত্র ভোটার কার্ড, একটি ভোট” এই স্লোগান তুলে সুষ্ঠু ও অবাধ এবং নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি তুলেছিলেন মমতা। ঠিক তার এক ‘বছর আগেই বিপুল জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসে চতুর্থ বামফ্রন্ট সরকার। কিন্তু ভোটার তালিকায় ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ তোলে রাজ্যে তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল জাতীয় কংগ্রেস। সচিত্র ভোটার কার্ড ছাড়া কোনও নির্বাচন নয় বলে দাবি তুলে মহাকরণ অভিযানের ডাক দেন যুব কগ্রেস নেত্রী তথা দক্ষিণ কলকাতার সাংসদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
আরও পড়ুন
মেয়ো রোডে প্রাথমিকভাবে সমাবেশ হয় এবং তারপর পুলিশ মেয়ো রোডেই মিছিল আটকে দিলে পুলিশের সঙ্গে তৎকালীন যুব কংগ্রেস কর্মীদের ধস্তাধস্তি শুরু হয়। সেদিন পুলিশি বাধা টপকে মহাকরণের দিকে এগিয়ে ছিল মমতা নেতৃত্বাধীন যুব কংগ্রেস কর্মীরা। পুলিশের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয় ১৪৪ ধারা ভেঙে মিছিল করার চেষ্টা করা হয়েছিল যার মধ্যে অনেক রাজনৈতিক কর্মীরাই ছিলেন সশস্ত্র। এই অভিযোগ তুলেই পুলিশ প্রাথমিকভাবে কাঁদানে গ্যাস ছোঁড়ে, শূন্যে গুলি চালায়। কিন্তু তাতেও আন্দোলনকারীদের দমানো যায়নি।
আন্দোলনকারীরা যখন পুলিশি বাধা টপকে মহাকরণের দিকে এগিয়ে যায় তখনই পুলিশের পক্ষ থেকে আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্যে সরাসরি গুলি চালানো হয়। পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হয় ১৩ জন যুব কংগ্রেস কর্মীর। আন্দোলনকারীদের হামলায় একাধিক পুলিশ কর্মী ও আধিকারিক গুরুতর আহত হন বলেও পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়। ১৯৯৩ সালের ২১ জুলাই যে ১৩ জন পুলিশের গুলিতে মারা গিয়েছিলেন তাঁরা হলেন– শ্রীকান্ত শর্মা, বন্দন দাস, দিলীপ দাস, মুরারী চক্রবর্তী রতন মণ্ডল, কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিশ্বনাথ রায়, অসীম দাস, কেশব বৈরাগী, রঞ্জিত দাস, প্রদীপ রায়, আব্দুল খালেক ও ইনু মিঞা।
১৯৯৩ সালের ২১ জুলাই যে ১৩ জন পুলিশের গুলিতে মারা গিয়েছিলেন তাঁরা হলেন– শ্রীকান্ত শর্মা, বন্দন দাস, দিলীপ দাস, মুরারী চক্রবর্তী রতন মণ্ডল, কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিশ্বনাথ রায়, অসীম দাস, কেশব বৈরাগী, রঞ্জিত দাস, প্রদীপ রায়, আব্দুল খালেক ও ইনু মিঞা।
রাজ্যে ২০১১ সালে রাজনৈতিক পালাবদলের পর ১৯৯৩ সালের এই গুলিচালনা নিয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন করেছিলেন বালা বদলে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯৯৩ সালের ২১ জুলাই পুলিশের এই গুলি চালনা ঘটনাকে জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের থেকেও নিকৃষ্টতম বলে কমিশনের শুনানিতে উল্লেখ করেছিলেন কমিশনের চেয়ারম্যান প্রাক্তন বিচারপতি সুশান্ত চট্টোপাধ্যায়। আর এই ১৩ শহীদের স্মৃতি তর্পণ করতেই ১৯৯৪ সাল থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্যোগে কলকাতায় ২১ জুলাইতে রাজনৈতিক সমাবেশ করা হয়।
ইউটিউবেও জাজবাত, আপডেট থাকুন আমাদের সঙ্গে
১৯৯৮ সালে তৃণমূল কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পর একুশের সমাবেশ মূলত যুব কংগ্রেসের হাত থেকে ছিনিয়ে নেয় তৃণমূল কংগ্রেস। ২০১১ সালে রাজ্যের রাজনৈতিক পালা বদলের পর এই ২১ জুলাইয়ের রাজনৈতিক সমাবেশই তৃণমূলের দিকদর্শনের মঞ্চ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। এবারের একুশের মঞ্চেও ছাব্বিশের নির্বাচনী বার্তা এবং রণকৌশলের দিকনির্দেশ করবেন তৃণমূল নেত্রী তা বলাই বাহুল্য।