রোদে ঝলসে যাওয়া দুপুরটা ছিল ঠিক এমনই একদিন ১৯৯৩ এর ২১ শে জুলাই। রাজপথে জুতোহীন পায়ে হেঁটে আসছিল কিছু স্বপ্ন দেখা তরুণ। কেউ ছাত্র, কেউ দিনমজুরের সন্তান, কেউ কলেজ ফেলে মিছিলে এসেছে! কারণ তারা চেয়েছিল গণতন্ত্র, কাজ চেয়েছিল, কণ্ঠ চেয়েছিল। পুলিশের গুলিতে লুটিয়ে পড়ে গেল ১৩টা জীবন। কারও বুক ঝাঁঝরা হয়ে গেল, কারও মাথা ফেটে গেল, কিন্তু কণ্ঠ রুদ্ধ হয়নি, তাদের রক্ত লিখে গেল একদিনের নাম: শহিদ দিবস। সেই ২১ জুলাই যখন আসে, তাদের কথা কি কেউ সত্যিই মনে রাখে?
জাজবাত বাংলায় আরও পড়ুন
এখনকার ২১ জুলাই সেই ইতিহাসকে চাপা দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছে এক ‘রাজনৈতিক রিয়্যালিটি শো’। শহিদ মঞ্চে আজ আর শহিদদের নাম নেই, ফুল নেই, শ্রদ্ধার নিঃশব্দতাও নেই। আছে শুধু সাউন্ডবক্সে চিৎকার, “জয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়! জয় অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়!” ব্যানারে লেখা “বাংলা বাঁচাও, বিজেপি হটাও।” অথচ, যাঁদের স্মরণে এই শহিদ দিবস তাঁদের নাম বলতে পারে না সভায় যাওয়া অধিকাংশ লোকই। ১৯৯৩ সালের ২১ জুলাই যুব কংগ্রেসের ‘মহাকরণ অভিযান’-এ পুলিশের গুলিতে নিহত হন ১৩ জন। বন্দন দাস, মুরারী চক্রবর্তী, রতন মণ্ডল, বিশ্বনাথ রায়, কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, অসীম দাস, কেশব বৈরাগী, শ্রীকান্ত শর্মা, দিলীপ দাস, প্রদীপ রায়, রঞ্জিত দাস, মহম্মদ আব্দুল খালেক ও ইনু, এই নামগুলো আজ কারো ব্যানারে নেই, কারও মুখে নেই, স্লোগানে তো একেবারেই না! কই, কেউ তো বলছে না, “জয় রতন মণ্ডলের জয়!” কিংবা “জয় বিশ্বনাথ রায়ের জয়!” ইতিহাসের এই মহান ত্যাগীরা আজ হয়ে উঠেছেন শুধু একবার উচ্চারিত নাম, তাও যদি কেউ মনে রাখে।
আজকের শহিদ মঞ্চে রাজনীতি দানবের মতো গিলে ফেলেছে শ্রদ্ধার আবেগকে। শহিদদের ছবি নয়, শোভা পাচ্ছে নেত্রীদের কাটআউট। শ্রদ্ধার অর্ঘ্য নয়, বরং চলছে দলের প্রচার, নেতানেত্রীর নামে জয়ধ্বনি, গোষ্ঠীর শক্তি প্রদর্শনের কৌশল। ব্যানারের ভাষা, স্লোগানের শব্দ, এমনকি মঞ্চের রং, সবই পরিকল্পিত, কিন্তু কোথাও নেই সেই তেরোজন শহিদের স্বীকৃতি, যাঁদের রক্তে রাঙা হয়েছিল রাস্তাঘাট। ২১ জুলাই আজ এক ‘পলিটিক্যাল ফেস্টিভ্যাল’, ক্যামেরার সামনে কান্নার অভিনয়, নেতা-নেত্রীর বক্তব্য, আর সর্বোপরি, দলীয় হাইকম্যান্ডের প্রতি আনুগত্যের শপথ। গণতন্ত্রের জন্য যে দিনটি ছিল উৎসর্গীকৃত, তা আজ হয়ে উঠেছে দলীয় পদলেহনের প্রতীক। প্রশ্ন জাগে, এই কর্মীরা কি সত্যিই জানেন শহিদ দিবসের তাৎপর্য? না কি তাঁদের শিখিয়ে দেওয়া হয়েছে শুধু নেতা বন্দনার মন্ত্র?
আরও পড়ুন
শহিদদের নাম চাপা পড়েছে নেতাদের নামে, ইতিহাসের রক্তাক্ত অধ্যায় ঢেকে গিয়েছে ফটোশুটের ফ্রেমে। যাঁরা জীবন দিয়েছিলেন, তাঁদের উত্তরসূরিরা আজ তাঁদেরই স্মৃতিকে বানিয়েছেন ভোটের প্যাকেজ। শহিদ দিবস আজ শোকের নয়, এক ‘রাজনৈতিক রিমিক্স’ যেখানে মূল ট্র্যাক নেই, আছে শুধু ব্যাকগ্রাউন্ড বিট! শহীদদের জন্য নেই মোমবাতি, নেই স্তব্ধতা, আছে DJ বাজনা আর দলীয় স্টারকাস্ট। আজ যদি শহিদ রতন মণ্ডল, কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় বা ইনু ফিরে এসে এই মঞ্চ দেখতেন, তাঁরা হয়তো রক্ত নয়, হাসতেন! এক নির্মম ব্যঙ্গের হাসি। কারণ তাঁদের মৃত্যু এখন শুধুই মঞ্চ সাজানোর উপকরণ। প্রশ্ন জাগে, এত ব্যানার, এত ব্যস্ততা, এত জলপানীর ভিড়ে শহিদদের আসন কোথায়? ২১ জুলাই এখন এক এমন নাট্যমঞ্চ, যেখানে শহীদরা শুধুই প্রপ, আর মূল চরিত্র নেত্রী-ভক্ত বীরেরা। যে শহিদদের রক্তে ভিজে তৈরি হয়েছিল এই পথ, তাঁদের নাম না জানলে, তাঁদের জন্য এক মিনিট নীরবতাও যদি না থাকে, তবে এই সভা সত্যিই কী শহিদ সভা?