রাজা বন্দ্যোপাধ্যায়
রাহুল গান্ধী নন, বিরোধীদের ইন্ডিয়া ব্লকে নেতৃত্বের মুখ যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তা আরও একবার পরিষ্কার হয়ে গেল সোমবার দিল্লিতে বিরোধীদের নির্বাচন কমিশন ঘেরাও কর্মসূচির মধ্যে দিয়ে। রাহুল-প্রিয়াঙ্কার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সংবাদ মাধ্যমের নজর কাড়লেন মহুয়া মৈত্র, সুস্মিতা দেবরা।
সোমবারের এই কর্মসূচি মূলত তৃণমূল নেত্রীর মস্তিষ্কপ্রসূত। কলকাতায় একুশে জুলাই শহিদ দিবসের সভামঞ্চ থেকে তিনিই প্রথম দিল্লিতে নির্বাচন কমিশনের সদর দফতর ঘেরাওয়ের ডাক দিয়েছিলেন। সংসদের বাদল অধিবেশন শুরুর প্রথম দিন থেকেই তৃণমূল ও অন্যান্য বিরোধীরা এসআইআরের বিরোধিতায় সরব। ইন্ডিয়া জোটের সংসদীয় দলনেতাদের বৈঠকে মমতার এই প্রস্তাব বাকিদের কাছে পেশ করেন রাজ্যসভার দলনেতা ডেরেক ও’ব্রায়েন। বাকিরা সেই প্রস্তাবে সম্মত হন। এরপর রাহুল গান্ধীর ডাকা বিরোধী নেতাদের নৈশভোজে তৃণমূলের সেকেন্ড ইন কমান্ড তথা নতুন দায়িত্ব পাওয়া লোকসভার দলনেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় অভিযানের রূপরেখা চূড়ান্ত করেন। তারই ফসল সোমবার রাজধানীর বুকে গোটা বিরোধী শিবিরের ৩০০-র কাছাকাছি সাংসদের এই ব্যাপক কর্মসূচি। ইন্ডিয়া জোট ছেড়ে বেরিয়ে গেলেও এদিনের কর্মসূচিতে শামিল ছিলেন অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টির সাংসদরাও।
পরিস্থিতির প্রয়োজনে জোট গড়লেও কংগ্রেস যে শরিক দলদের গুরুত্ব দেয় না, এই অভিযোগ দীর্ঘদিনের। দিল্লি বা পঞ্জাবে কেজরিওয়ালকে জমি ছাড়তে রাজি হননি রাহুল গান্ধী। উত্তরপ্রদেশে অখিলেশ যাদবকেও একই সমস্যায় ভুগতে হয়েছে অতীতে। ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনের আগে ইন্ডিয়া জোট তৈরি করলেও হরিয়ানা, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়ের মতো রাজ্যগুলিতে শরিক দলগুলিকে গুরুত্ব না দিয়ে একাই লড়েছিল কংগ্রেস। উদ্দেশ্য ছিল জিতলে যাতে জোটের নেতৃত্বের ব্যাটন থাকে তাদের হাতেই। কিন্তু ফল হয়েছে উল্টো। সব কটা রাজ্যেই বিজেপির কাছে গোহারা হেরেছে তারা।
অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গে ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনে কার্যত একার হাতে বিজেপিকে উড়িয়ে দেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তারপর থেকেই বিরোধী শিবিরের অন্য শরিক দলগুলি আওয়াজ তুলতে শুরু করে, জাতীয় পর্যায়ে বিরোধী জোটকে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে মমতারই।
২০২১-এর প্রতিফলন হয় ২০২৪-এও। বিজেপিকে প্রধান শত্রু হিসেবে দেখার পরিবর্তে সিপিএমের সঙ্গে জোট বেঁধে, তৃণমূলের বিরোধিতা করাতেই বেশি মন দেয় কংগ্রেস। মালদহ দক্ষিণ ছাড়া আর কোনও আসন জোটেনি কংগ্রেসের কপালে। পাঁচবারের সাংসদ তৎকালীন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর রঞ্জন চৌধুরী পর্যন্ত হেরে যান তাঁর নিজের কেন্দ্র বহরমপুরে।
এরপরই মনে হয় কিছুটা শিক্ষা নিয়েছে শতাব্দীপ্রাচীন এই দলটি। চলতি বাদল অধিবেশনে তৃণমূলকে কাছে টানতে বাড়তি উদ্যোগ নিতে দেখা গেছে মল্লিকার্জুন খাড়গে, রাহুল গান্ধীদের। এসআইআরের পাশাপাশি বিভিন্ন রাজ্যে বাংলাদেশি ধরার নামে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের হেনস্থা নিয়ে প্রথম থেকেই সরব তৃণমূল সাংসদরা। অধিবেশন শুরুর আগে সংসদ ভবন প্রাঙ্গণে সাংসদদের প্রতিদিনের বিক্ষোভ কর্মসূচিতে যোগ দিচ্ছেন কংগ্রেসের সাংসদরা। এমনকী লোকসভাতে এই নিয়ে আলোচনা চেয়ে তৃণমূলের পাশাপাশি মুলতবি প্রস্তাব জমা দিয়েছিলেন কংগ্রেস সাংসদ মানিকম টেগোর।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে এড়িয়ে বিজেপিকে যে আটকানো যাবে না, তা বোধহয় উপলব্ধি করছে কংগ্রেস। সেজন্যই তৃণমূল নেত্রীর নির্বাচন কমিশন ঘেরাও কর্মসূচির প্রস্তাবে সাড়া দিতে এক মুহূর্ত দেরি করেনি তারা। সোমবার ঐক্যবদ্ধ বিরোধী শিবিরের ব্যাপক জমায়েতে রাহুল গান্ধীরা যে বাড়তি অক্সিজেনটুকু পেলেন, তার মূল কৃতিত্ব কার্যত মমতারই।