রাজা বন্দ্যোপাধ্যায়
বিহারের রাজনৈতিক মঞ্চে বিজেপির যাত্রাপথ কখনই সোজা পথে হয়নি। জাতপাতের জটিল সমীকরণ, চিরাগ পাসোয়ান, জিতনরাম মাঝির মতো ছোট শরিকদলের বাড়তি আসন (cake share) নিয়ে দর কষাকষি এবং নীতীশ কুমারের বারবার পিংপং বলের মতো রাজনৈতিক অবস্থান পরিবর্তন। এই কারণে বিজেপি গত দুটি নির্বাচনে আসন সংখ্যায় বৃহত্তর শক্তি থাকা সত্ত্বেও নীতীশ কুমারকে মুখ্যমন্ত্রী করতে বাধ্য হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির “ডাবল ইঞ্জিন সরকার”-এর স্লোগান বিহারে শোনা গেলেও বাস্তবে বিজেপি কখনই মুখ্য ইঞ্জিন নয়, বরং ছিল নীতীশের গাড়ির সহযোগী কামরা।
২০০৫ সালে লালুপ্রসাদ যাদবের দীর্ঘ শাসনকাল শেষ করে নীতীশ কুমার মুখ্যমন্ত্রী হন, “জঙ্গল রাজ”-এর বদনাম কাটিয়ে। আইনশৃঙ্খলা, সড়ক, বিদ্যুৎ ও শিক্ষা ক্ষেত্রে উন্নতির কারণে তিনি “সুশাসন বাবু” নামে পরিচিত হন।
বিজেপি তখন তাঁর পাশে থেকে শক্তি জোগায় এবং ২০১০ সালের নির্বাচনে এনডিএ অভূতপূর্ব জয় পায়। তবে এখানে নেতৃত্ব ছিল নীতীশের হাতে, বিজেপি ছিল সহযোগী শরিক দল।
২০১৩ সালে নরেন্দ্র মোদিকে প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী ঘোষণা করা হলে নীতীশ জোট ভেঙে দেন, কারণ তিনি মনে করেছিলেন মোদি বিহারের জন্য অত্যন্ত মেরুকরণকারী নেতা। ২০১৫ সালে নীতীশ মহাগঠবন্ধনে যোগ দিয়ে বিজেপিকে বড় ধাক্কা দেন। স্লোগান ওঠে “বিহার বনাম বাহারওয়ালে।”
কিন্তু ২০১৭ সালে লালুপ্রসাদ যাদবের দুর্নীতির কেলেঙ্কারিতে অস্বস্তি তৈরি হলে নীতীশ আবারও বিজেপির সঙ্গে হাত মেলান। ২০২০ সালে যদিও বিজেপি ৭৪ আসন জেতে এবং জেডিইউ পায় মাত্র ৪৩, তবু মুখ্যমন্ত্রী পদ ছাড়তে হয় নীতীশকে। বিজেপি কর্মী-নেতারা এতে ক্ষুব্ধ হলেও মিত্রতা বজায় রাখা ছাড়া বিকল্প ছিল না।
২০২৪ সালের মে মাসে প্রাক্তন উপমুখ্যমন্ত্রী ও বিজেপির বর্ষীয়ান নেতা সুশীল কুমারের মৃত্যু বিজেপিকে বড় ধাক্কা দেয়। তিনি ছিলেন নীতীশের সঙ্গে বিজেপির সম্পর্কের প্রধান সেতুবন্ধন।
তাঁর অনুপস্থিতিতে দল এখন নেতৃত্ব সংকটে ভুগছে। বর্তমান প্রজন্মের বিজেপি নেতা সম্রাট চৌধুরী, নিত্যানন্দ রায়, রাজীব প্রতাপ রুডি বা শাহনওয়াজ হুসেন, কেউই নীতীশের সমকক্ষ নন। দিলীপ জয়সওয়াল বা নীতীশ মিশ্রর মতো তরুণ মুখও এখনও গ্রহণযোগ্যতা পাননি। ফলে দল আবারও প্রধানমন্ত্রী মোদির জনপ্রিয়তার ভরসায় দাঁড়াতে বাধ্য হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জনপ্রিয়তা নিঃসন্দেহে বিজেপির অন্যতম শক্তি। তবে বিহারের রাজনীতি মূলত জাতপাতকেন্দ্রিক ও স্থানীয় নেতৃত্বনির্ভর। এর ওপর যোগ হয়েছে মহিলা ভোটার সংক্রান্ত বিষয়। রাজ্য রাজনীতিতে মদ বিক্রি নিষিদ্ধ করা থেকে শুরু করে, মহিলাদের জন্য একাধিক প্রকল্প ঘোষণা করে ইতিমধ্যেই ১৫ বছর ধরে মহিলা ভোট অর্জন করেছেন নীতীশ। মোদি হয়ত বুঝেছেন, বিহারে শুধুমাত্র জাতীয় ক্যারিশমা দিয়ে নির্বাচনে জেতা যায় না। ভোটাররা মুখ্যমন্ত্রী পদে স্থানীয় নেতৃত্বকে গুরুত্ব দেন, আর সেখানেই বিজেপি পিছিয়ে পড়ছে।
আগামী বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি কি আবারও নীতীশ কুমারকে মুখ্যমন্ত্রী মুখ করে যাবে, নাকি এবার নিজস্ব প্রার্থী তুলে ধরবে? দিল্লিতে অমিত শাহর নেতৃত্বে আসন ভাগাভাগি নিয়ে আলোচনা চলছে। বিজেপি ২০২০ সালের চেয়ে বেশি আসন দাবি করতে চাইছে, তবে জেডিইউ-এর ওপর নির্ভরতা এখনও অটুট।
বিহারে বিজেপির রাজনৈতিক যাত্রা আজও এক অপূর্ণ ধাঁধা। জাতীয় স্তরে ক্ষমতার দাপট থাকলেও রাজ্যে তারা এখনও যাত্রী, চালক নীতীশ কুমারের স্বাস্থ্য, সম্ভাব্য অবসর এবং জেডিইউ-এর ভবিষ্যৎ— সবকিছুই নির্ধারণ করবে বিজেপি ২০২৫-এ বিহারে নিজেদের ‘ডাবল ইঞ্জিন’ দাবি বাস্তবে প্রমাণ করতে পারবে কি না।