অভিমানে চলে যেও না…
দিব্যেন্দু ঘোষ
শমীক ভট্টাচার্য রাজ্য সভাপতি। শুভেন্দু অধিকারী বিধানসভায় বিরোধী দলনেতা। সুকান্ত মজুমদার কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। তিনি কোত্থাও নেই। না বিধায়ক, না সাংসদ, না গুরুত্বপূর্ণ কোনও পদ। তবুও তিনি আছেন। ভীষণভাবে আছেন। নিন্দুকেরা বলছে বটে, উপেক্ষার হ্যাটট্রিক, কিন্তু তাঁকে উপেক্ষা করা যায় না। যাবে না। ‘রিজার্ভ ফোর্সের প্লেয়ার। অর্ডার এলে কাজ করেন। দলের সাধারণ কর্মী’। দলের কাজ নিয়ে বলতে গিয়ে বিনয়ী আরএসএসের পোড় খাওয়া সৈনিক। কলকাতায় মোদির কর্মকাণ্ডের সময় তিনি বেঙ্গালুরুতে। কেন? কেউ জানে না। নিজে বলছেন, ‘সংগঠনের কাজ। মোদির ভাষণ তো মোবাইলেও শোনা যায়’। তিনিই বলতে পারেন, একমাত্র তিনিই। দাপট সাঙ্ঘাতিক। চালিয়ে খেলতেই বরাবরের পছন্দ। তাই মাঝে মাঝেই মাঠে ছোটেন। ইডেন, যুবভারতীতে তাঁকে দেখা যায়। এখন জীবনসঙ্গী হয়েছে। রিঙ্কু মজুমদার। তিনিও বিজেপি কর্মী। সঙ্গে থাকেন। পাশে থাকেন। থাকতে হয়, কারণ জীবনে ঝড়ঝাপ্টা তো কম নয় সোজাসাপ্টা বলা মানুষটার। কেউ আপত্তিকর ভিডিয়ো ভাইরাল করে দেন। ভিডিয়ো কতটা ঠিক, কতটা নয়, কেউ জানে না। ভিডিয়োতে আদৌ কি তিনি? তাও স্পষ্ট নয়। তাই অভিযোগ করেন দিলীপ, সস্ত্রীক। কেউ বা কারা তাঁকে অপদস্থ করার চেষ্টা করছেন। কেন? সাংগঠনিকভাবে তাঁর সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছেন না বলে? মেদিনীপুরের মতো জেতা আসন থেকে সরিয়ে নিয়ে এসে চব্বিশের লোকসভা ভোটে তাঁকে বর্ধমান-দুর্গাপুর থেকে প্রার্থী করতে হয়। সংগঠনের ঝানু মানুষটাকে হারিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত। দিলীপ নেই, কোত্থাও, ফলে খোলা মাঠে খেলা যাবে। দিলীপকে কোণঠাসা করতে গিয়ে পার্টিটাকেই কমজোরি করছেন দলেরই একটা বড় অংশ। কেন? বিস্ফোরক রাজনৈতিক অঙ্ক কি পিছনে? হতে পারে। শুভেন্দু-সুকান্ত না বুঝুন, মোদি-শাহও বুঝবেন না? নাকি অন্য সমীকরণ!
সমীকরণ যাই হোক, তিনি ছাড়ছেন না। কেউ কেউ তো তাঁকে তৃণমূলে যোগদান করিয়েই ফেলেছিল। একুশে জুলাই তাঁকে নাকি দেখা যাবে তৃণমূলের শহিদ সমাবেশের মঞ্চে। দেখা যায়নি। দেখা যেতে পারে না। তিনি সঙ্ঘ-যোদ্ধা। দলবদল ব্যাপারটা ওঁদের কাছে জলভাত নয়। আদর্শবাদী। নিজের নিয়মে চলেন। দলকে হাস্যকর করে তোলেন না। ধাতে নেই। কাজের অর্ডার না এলে বসে যাবেন। নিজের দল তৈরি করতে পারেন। কিন্তু দলবদল নৈব নৈব চ। বিজেপির সেই প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি ২৯ মে আলিপুরদুয়ার, ১৮ জুলাই দুর্গাপুরের পর দমদমেও প্রধানমন্ত্রীর সভায় ব্রাত্য। আমন্ত্রণ পাননি। তাই যাননি। ঠোঁটকাটা। ইকো পার্কে রোজ মর্নিং ওয়াক করেন। সাংবাদিকরা ছেঁকে ধরেন। তিনিও টি-টোয়েন্টির মেজাজেই ব্যাট চালান। রাখঢাক না করেই বলেন। বরাবর বিস্ফোরক। নিজের দল হোক বা অন্যের দল। সেই তাঁকে এড়িয়ে চলছে বঙ্গ বিজেপি। কেন? সদুত্তরও মেলেনি দলের রাজ্য নেতৃত্বের কাছ থেকে। দলের রাজ্য সভাপতি বলছেন, ‘খুব তাড়াতাড়ি তাঁকে আবার চেনা ছন্দে দেখা যাবে’। কিন্তু রয়্যাল এনফিল্ড চালানো শখ যে মানুষটার, তাঁর ঘনিষ্ঠদের দাবি, দলে তাঁর অবস্থার কোনও উন্নতি হয়নি। দুর্গাপুরে মোদির সভার সপ্তাহখানেক আগে তিনি নিজেই ঘোষণা করেছিলেন, দলের শীর্ষ নেতারা আমন্ত্রণ না করলেও স্থানীয় বিজেপি কর্মীদের ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি দুর্গাপুরে যাবেন। শেষ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত বদল করেন। জানিয়েছিলেন, দলকে বিড়ম্বনা থেকে বাঁচাতেই তিনি প্রধানমন্ত্রীর সভা শুনতে দুর্গাপুর যাবেন না। কারণ তিনিই বলেন, ‘যেতেও পারি, আবার নাও পারি। আমি কোথায় যাব, সেটা আমিই ঠিক করব’। তাই তো দিঘায় জগন্নাথ মন্দিরে সস্ত্রীক চলে যান। জমিয়ে খোশগল্প করেন মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে। তিনি পারেন। তিনিই পারেন।
তিনিই কখনও কখনও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হত্যা ও গণহত্যার ডাক দেন, প্রতিবাদকারীদের লক্ষ্য করে হুমকি দেন, অশান্তি সৃষ্টির উস্কানি দেন। কারণ বিতর্ক আর তিনি তো সমার্থক। ২০১৬-য় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের ‘নিম্নমানের ও লজ্জাহীন’ বলে বিতর্ক সৃষ্টি করেছিলেন। দাবি করেছিলেন, তারা ছেলেদের সঙ্গ পেতে সর্বদা উদগ্রীব। তিনি গরুর মাংস খাওয়া বুদ্ধিজীবীদের উদ্দেশ করে বলেন, ‘রাস্তায় গরুর মাংস খাওয়ার বদলে বাড়িতে কুকুরের মাংস খান’। ২০১৯-এ টিএমসি কর্মীদের হাতে বিজেপি কর্মীদের ওপর নিপীড়নের জবাবে তিনি হুমকি দেন, ‘টিএমসি কর্মীদের পরিবার নিশ্চিহ্ন করে দেব যদি তাদের হত্যা শুরু করি’। ওই বছরই যাদবপুরের পড়ুয়াদের ‘দেশদ্রোহী’ ও ‘সন্ত্রাসী’ আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, ‘কমিউনিস্টদের তাড়াতে বালাকোটের মতো সার্জিক্যাল স্ট্রাইক করা হবে। বিদেশি গরুকে ‘মাসি’ ও ভারতীয় গরুর দুধে ‘সোনা’ আছে বলে মন্তব্য করতে পারেন তিনিই। সিএএ-বিরোধী বুদ্ধিজীবীদের ‘শয়তান’ ও ‘পরজীবী’ বলেন অনায়াসে। ‘জেলে না গেলে রাজনৈতিক নেতা হওয়া যায় না’, এই মন্তব্য তাঁর মুখ থেকেই শোনা যায়। দেবী দুর্গার পিতৃপরিচয় নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি রামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করলে টিএমসি কর্মীরা মাথা কামিয়ে প্রতিবাদ করে। শাহিনবাগ বিক্ষোভ নিয়ে তিনিই বলেন, ‘এখানে কেউ অসুস্থ বা মরছে না কেন?’ ২০২০-তে তিনি দাবি করেন, ‘সিএএ-বিরোধীরা অশিক্ষিত ও গরিব, বিদেশি টাকায় বিরিয়ানি খেয়ে বিক্ষোভ করছে। ২০২১-এর নির্বাচনী প্রচারে তিনি মমতাকে প্লাস্টার করা পা দেখাতে ‘বারমুডা’ পরার পরামর্শ দেন। মমতার চরিত্র ও বংশপরিচয় নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্যও করেন। পুলিশকে ‘পায়ের তলায় কাজ করতে হবে’ বলেও বিতর্ক তৈরি করেন। নেতাজিকে নিয়েও বিতর্কিত মন্তব্য করেন।
তিনি আর কেউ নন। তিনি দিলীপ ঘোষ। অনেকেই আজ বলছেন, অভিমানে চলে যেও না…